একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে চরম বিব্রত হচ্ছে সরকার। দুর্নাম যেন সরকারের পিছু ছাড়ছেই না। সরকারের কিছু কিছু সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে নানা কেলেঙ্কারি আর অপবাদ। ছোটখাটো ঘটনায়ও সরকারবিরোধী সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছে সারা দেশ।
এসব ক্ষেত্রেও সরকারের বিভিন্ন অংশের চরম অবহেলা ও ব্যর্থতা নিয়ে কথা উঠছে নানা মহলে। বলা হচ্ছে, দায়িত্বশীল কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দলীয় নেতারাও সরকারকে সমালোচনা থেকে রক্ষার কোনোরকম উদ্যোগ নিচ্ছেন না। ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রেও তাদের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। সরকারের ভালো কাজের ইতিবাচক দিকগুলো তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থাপনাও দেখা যাচ্ছে না।
দেশজুড়ে খুন-গুম-অপহরণের ঘটনায় ক্রমাগত বিব্রত হয়ে চলেছে সরকার।
সাত খুনে বিতর্কিত: নারায়ণগঞ্জে অপহরণের পর সাতজনকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার নৃশংস ঘটনা নিয়ে সরকার কয়েক দফা বিতর্কিত হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধির একজন আরেকজনকে অভিযুক্ত করছেন। অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনী র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। এদের একজন আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীর জামাতা। বিতর্কে বিব্রত পরিস্থিতি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
ওই ঘটনায় র্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাকেও টেনে যোগ করার চেষ্টা চলছে। পাল্টা চেষ্টা চলছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী আরেক নেতাকে জড়িত করার। পরস্পরবিরোধী কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দরকার হয়নি, সেখানে আওয়ামী লীগই হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু, সরকারের প্রতিপক্ষ।
মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের পাহাড়: আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে এমপি-মন্ত্রীদের দুর্নীতি, অনিয়ম, সম্পদ প্রাচুর্যের পাহাড় গড়ে ওঠা নিয়েও সরকার দেশজুড়ে সমালোচিত হয়। বিতর্ক আর দুর্নাম পিছু ছাড়েনি সরকারের। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সরকারি দলের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি হয়ে উঠেছেন অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক। এই সময়ে সরকারদলীয় অনেকের সম্পদ বেড়েছে দুই হাজার থেকে প্রায় তিন হাজার গুণ। মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অথচ পাহাড়সম সম্পদের মালিক বনে যাওয়া এমপি-মন্ত্রীদের অনেকে মাত্র পাঁচ বছর আগেও ছিলেন নিছক একজন কৃষক, কেউবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেই ঋণ আর শ্বশুরবাড়ির দানের টাকায় নির্বাচন করেছেন বলেও হলফনামায় উল্লেখ রয়েছে। এত অল্প সময়ে সাধারণ মানের এসব পেশা থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠায় জনমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। অতি দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার মধ্যে যাদের নাম উঠে আসে তারা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নূর-ই-আলম চৌধুরী, হাসান মাহমুদ, আবদুর রহমান বদি, এম এ লতিফ, আসলামুল হক ও এনামুল হক। এর মধ্যে আবদুল মান্নান খানের সম্পদ বেড়েছে ১০৭ ভাগ, নূর-ই-আলম চৌধুরীর ৬৭ গুণ, হাসান মাহমুদের ৪০ গুণ ও তার স্ত্রীর বেড়েছে ২ হাজার ২৯০ গুণ, আবদুর রহমান বদির বেড়েছে ৩৫১ গুণ। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া অঢেল সম্পদের বিবরণেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা যে সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন, তা এবার বেড়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। সবচেয়ে বেশি চমক দেখিয়েছেন সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান। তার ২০ একর জমি পাঁচ বছরে বেড়ে দাঁয়িড়েছে ২ হাজার ৮৬৫ একরে। মন্ত্রী হওয়ার পর তার মূল বিনিয়োগ ছিল জমিতে। এ ছাড়া বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭৯ গুণ। পাঁচ বছর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাহবুবুর রহমানের জমা টাকা ছিল ৮৩ হাজার ১১২ টাকা। এখন তার নিজের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাই আছে চার কোটি ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮২ টাকা। জানা গেছে, শুধু একজন মাহবুবুর রহমান নন, এভাবে সম্পদ বেড়েছে প্রভাবশালী সরকারের সব মন্ত্রী-এমপির। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আগত মান্নান খানও বাদ যাননি। মন্ত্রী হয়ে নানা বেনামে কম-বেশি সবাই আয় উন্নতি করেছেন। দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় আবদুল মান্নান খানের আয় ছিল ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। নির্ভরশীলদের কোনো আয়ই ছিল না। অথচ পাঁচ বছর পর তিনি ও তার স্ত্রী বা অন্য নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় আবদুল মান্নান খানের পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে বহুগুণ। মন্ত্রী-এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকার বা দলীয় পর্যায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো। যতটুকু ঘটছে তা আইওয়াশ বলেই মনে করেন দেশের সাধারণ মানুষ।
সহনশীল হচ্ছে না ছাত্রলীগ-যুবলীগ!: ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, গত মেয়াদের তুলনায় সরকারের চলতি মেয়াদে ছাত্রলীগ, যুবলীগের অপরাধ অপকর্ম অনেকটা কমলেও এখনও চলছে। ফলে স্বস্তি পাচ্ছে না সরকার। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, সরকারের গত মেয়াদে দলীয় নেতা-কর্মীদের বেশ কিছু ঘটনায় খোদ প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। তিনি কঠোর ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সহনশীল হয়েও এখনও শান্ত হয়নি গোটা পরিবেশ। যোগাযোগমন্ত্রী আগামী দিনগুলোতে সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম মানুষকে আরও বেশি স্বস্তি দেবে, শান্তি দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
জঙ্গি ছিনতাই থেকে উগ্রপন্থি ঘাঁটি: প্রিজন ভ্যান থেকে সাজাপ্রাপ্ত তিন জঙ্গিকে কমান্ডো স্টাইলে ছিনতাইয়ের ঘটনাও সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। র্যাব-পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক ক্রসফায়ারের ঘটনায় অনেক নিহত হওয়ার পরও বিশ্বে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি প্রশংসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু জঙ্গি অপহরণের ঘটনায় সেসব সাফল্য মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। বাংলাদেশের জঙ্গি গ্রুপগুলোর ক্ষমতা খর্ব হওয়া নিয়ে দেশের বাইরেও প্রশ্ন ওঠে। এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ির গহিন বনে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারসহ একের পর এক বাঙ্কার আবিষ্কার নিয়েও। র্যাবের ঝুঁকিপূর্ণ এ অভিযানে ভিনদেশি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর আস্তানা নির্মূল হওয়ায় বিশ্বজুড়ে যেখানে বাংলাদেশের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ার কথা, এর বদলে নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস আর রহস্যময়তার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ত্রিপুরা সীমান্ত-সংলগ্ন সাতছড়ি অভয়ারণ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো বিতাড়িত করার মতো বড় আকারের সরকারি পদক্ষেপও মামুলি বিষয় ও বিতর্কের মধ্যে ফেলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর নানা কার্যক্রমে পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছতা না থাকায় সরকার বারবার বিতর্কিত হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের অনিয়মে বিব্রত: আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কার্যক্রম থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র- সব পর্যায়েই নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারবিরোধী বিতর্কের সূত্রপাত ঘটানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদে হলমার্ক কেলেঙ্কারি যেমন সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল, সেটির রেশ শেষ হতে না হতেই বেসিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি সরকারকে নতুন মেয়াদেও বিতর্কিত করে তুলেছে। বেসিক ব্যাংকের বেহাল ব্যবস্থাপনা এতটাই খারাপ হয়েছে যে খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, সোনালী ব্যাংকের পর এখন আরেকটি ব্যাংক বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। আর তা হলো বেসিক ব্যাংক। জানা গেছে, শুধু অর্থমন্ত্রী নন, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলও বেসিক ব্যাংক নিয়ে বিব্রত। বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখায় ভুয়া ঋণের ছড়াছড়ি। এ শাখার ঋণের বিপরীতে জমির যেসব দলিল বন্ধক রয়েছে, এর অধিকাংশ ভুয়া, যার অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোনো মিল পাওয়া যায় না। ব্যাংকটির নানা আগ্রাসী কর্মকাণ্ড ও অনিয়ম জালিয়াতির ব্যাপারে একাধিকবার সতর্কও করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা কোনোভাবেই আমলে নেয়নি। বরং রাজনৈতক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বারবারই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। ঋণের টাকা ভাগাভাগি করা; অস্তিত্বহীন ভুয়া কাগুজে, বেনামি ও কর্মচারীদের নামে তৈরি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া; ঋণ ছাড়ের সময় কোনো শর্ত পালন না করাই হচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও ঋণগ্রহীতাদের নিত্যদিনের কাজ। এমনকি ঋণ হিসাবের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও সুদ চার্জ করে আয় দেখানো, নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে পুনঃ তফসিলিকরণ ছাড়াই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে খেলাপি না দেখানো এবং বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণের নামে বিপুল অর্থ আত্দসাতের সুযোগ করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে আরেক কোম্পানিতে এবং ভিন্ন খাতে ব্যবহারও করেছেন ঋণগ্রহীতারা। এসব অপকর্ম ও অনিয়মের মূলে রয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। সন্দেহের তালিকায় খোদ চেয়ারম্যানও রয়েছেন।