দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ পর্যবেক্ষনঃ জাতীয় রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়ে উঠেন ‘রহস্যমানব’। ক্ষমতা বদলের অনিশ্চয়তার কারণেই গত ১২ ডিসেম্বর ‘সমঝোতার অসুস্থতায়’ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর, ‘সমঝোতার অসুস্থতা’ নিয়ে শুরু হয় পানি ঘোলা করা। একপক্ষ আরেকপক্ষকে দোষারোপ করতে থাকে।
অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আবার নতুন করে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে রহস্য সৃষ্টি শুরু করেছেন। আরপিও’র ১৯ ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিটের শুনানি ও আগাম নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীন দল বিদেশীদের অব্যাহত চাপের মুখে থাকার প্রেক্ষাপটেই রহস্য ছড়ানর কাজে তৎপর হলেন তিনি।
বুধবার লালমনিরহাটে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, “আমি নির্বাচন করি নাই, আমার দল আমার নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছে। এ নির্বাচনের কোনো মূল্য নেই। এরশাদ আরো বলেন, তিনি অসুস্থ ছিলেন না, অথচ ভোটের সময় তাকে অসুস্থ বানিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি ফোন পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি’। অথচ বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে স্ত্রী রওশন এরশাদ, তরুণ-বন্ধু ববি হাজ্জাজ থেকে শুরু করে নিজের ভাই জি এম কাদের কিংবা ভোটার- সবার সাথেই ক্রমাগত মিথ্যা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করা নিয়ে ধারাবাহিক মিথ্যাচারের অংশ হিসেবে ‘সমঝোতার অসুস্থতায়’ সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এরশাদ। ‘সমঝোতার অসুস্থতায়’ হাসপাতালে গিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে সংসদ নির্বাচনের প্রায় তিন সপ্তাহ আগে পুলিশী প্রহরায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এরশাদকে। জাপার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে নানান অপ্রাঙ্গিক ও ভূয়া বক্তব্য রেখে প্রায়ই পরিস্থিতি ঘোলা করে ফেলছিলেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। এ কারণে নির্বাচন পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিমণ্ডল থেকে দূরে রাখতে সমঝোতার ভিত্তিতেই এরশাদকে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর হাসপাতালে থেকেই জনগণ থেকে শুরু করে নিকটজন- সবার সাথেই মিথ্যার বেসাতি চালান তিনি।
কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দল থেকে সবগুলো পাওনাই মিটিয়ে নিয়েছেন তিনি। এরশাদের তালিকা অনুযায়ী ৫০ জন জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জন্য আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সুযোগ-সুবিধা বুঝে নেওয়া ছাড়াও এরশাদের চাহিদা মতো তাকে জনতা ইন্সুরেন্স, জনতা টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়ার কাজটিও এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার পক্ষ থেকে জাপার এমপি প্রার্থীদের মধ্যে টাকা বিলি করার কাজও চলেছে ঠিক মত।
উল্লেখ্য, নানান নাটকীয়তা তৈরী করলেও জাপার মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা কেউই আদতে পদত্যাগ করেননি। শেষ পর্যন্ত, নিজের আসনে নিজে ভোট না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এইভাবে ক্ষমতাসীন দলের সাথে কোন রকম দ্বন্দ্বে না জড়িয়েও নিজেকে সম্পূর্ণভাবে রহস্যাবৃত করে রাখতে পারছেন অন্যতম বয়স্ক মামলা ‘মঞ্জু হত্যা মামলার’ আসামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর প্রতিদান স্বরূপ হত্যা মামলার আসামী হয়েও তিনি দশম সংসদের সাংসদ এবং পশ্চিমা বিশ্বে পরিচয় পেয়েছেন ‘কিং মেকার’ হিসেবে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এই ‘রহস্যময়’ আচরণের জট খোলা খুব কঠিন কাজ নয়। বিএনপিকে ছাড়া শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে গভীর সন্দেহ ছিল দেশের সকল মহলে। ওই অনিশ্চয়তার কারণেই, একাধিক মামলার আসামী এরশাদ চাইছিলেন সকল পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে। এই করে তিনি শেষ পর্যন্ত বাতাস যেদিকে যায়, সেদিকেই হেলে যাওয়ার পথ খোলা রেখেছিলেন। হয়েছেও তাই। ব্যাপক নাটকীয়তা, লুকোছাপা করে অবশেষে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও নিয়েছিলেন তিনি।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিরোধী দলীয় প্রধান হওয়ার জন্যও রওশন এরশাদের সাথে তুমুল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। অথচ হঠাৎ করেই নিজের নিকট অতীত ভুলে গিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক নতুন রহস্যে মন মজিয়েছেন এরশাদ।
একারণেই ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে এরশাদের নতুন উদ্দীপনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের একটি ঈঙ্গিত বহন করছে। আগাম নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত থাকলে এবং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে আরও নানান রহস্য সৃষ্টি করায় মনোনিবেশ করবেন তিনি।