বুকের ধন, চোখের মণি মা কুশিমণি হাসপাতালে। পায়ের একটা ক্ষত নিয়ে জন্মাবধি ভুগছে। দিন দিন বড় হচ্ছে, তাই কষ্ট হয়। কি নিষ্ঠুর প্রকৃতি! মামণি চোখ খুলে সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাটিচাপা পড়ে, কাকের আক্রমণে ডান গালের অনেকটা খুইয়েছিল। ওর প্রয়োজনীয় অপারেশন অনেক আগেই হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের প্রিয় সার্জন শাফকাত হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েক বছর পিছিয়ে পড়েছি।
কিন্তু এখন আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। যে মা আমার সারা দিন লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি, দাপাদাপি করে বাড়িঘর মাথায় রাখে- সেই সোনামণি আমার হাঁটতে গিয়ে ব্যথা পায়। কখনো-সখনো মুখ ভার করে থাকে। এতদিন যার কান্না শুনিনি, মুখ ভার দেখিনি, সেই কুশিমণির মুখ কালো, চোখে পানি দেখলে বুক জ্বলে যায়। মা'কে হারিয়ে যখন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, রাজপুত্র-রাজকন্যার মতো ছেলেমেয়ে থাকতেও দুনিয়ার সব কিছু অর্থহীন, আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছিল, যখন কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না ঠিক তখন আমার অন্ধকার ঘর-সংসার আলো করে কুশিমণি আসে।
দীপের পর কুঁড়ি যখন জন্মে তখন ওর মা'কে বলেছিলাম, 'আমার মেয়ে চাই। না হলে ফ্লোরে থাকবে। খাটে উঠতে পারবে না।' আল্লাহর অসীম দয়ায় চাঁদের মতো মেয়ে হয়েছিল। ১৫ বছর নির্বাসন কাটিয়ে ১৬ ডিসেম্বর '৯০-এ দেশে ফিরে রাত ২টায় মা-বাবার দোয়া নিতে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। সেখানে ১০ মাসের ছোট্ট কুঁড়ি আর মা'র পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম। আমরা বহুদিন মা-বাবাকে পেয়েছি, তাই মনে হয় কখনো বড় হইনি। মা-বাবার কোলের বাচ্চাই ছিলাম। তাই মা'কে হারিয়ে চোখে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখি, বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যখন বেঁচে থাকার আশা আগ্রহ কোনোটাই ছিল না তখন দেবদূতের মতো পরম করুণাময় আল্লাহ দয়া করে মায়ের প্রতিবিম্ব কুশিমণিকে আমায় দান করেন।
সে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত দুঃখ-দৈন্য-বেদনা কর্পূরের মতো উড়ে যায়। ওর আগে পিঠাপিঠি ছেলেমেয়ে দীপ-কুঁড়িকে নিয়ে কোথাও এক গাড়িতে যেতে পারতাম না। মাঝপথে দুজনকে দুই গাড়িতে দিতে হতো। এক সময় তেমন কিছু মনে হতো না। কিন্তু মেয়ের যখন ১২-১৩, ছেলের ১৮-১৯ তখনও ওদের চরম শত্রুর মতো কথাবার্তা, হাতে পায়ে ঝগড়া দেখে ভয় পেতাম, তবে কি বড় হয়েও এমন করবে? আমার তিন বোন, এখনো আমার জন্য পাগল। আমরা ভাইয়েরাও বোনের জন্য অস্থির। কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে কেন অমন করে কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু আমার মা কুশিমণি এক টুকরো মাংসের মতো তার মায়ের বুকে চেপে যেদিন এলো, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল_ কে কার আগে কোলে নেবে, কে কতক্ষণ কোলে রাখবে। আমাদের কুশিমণি বিছানায় থাকার চেয়ে ওর মা-ভাইবোন আর আমার কোলে কোলে থেকেছে বেশি।
ওর জ্বলজ্বলে চোখ দেখে প্রথম যেদিন আটকে গিয়েছিলাম, আজও সেই চোখ তেমনি আমায় আটকে রেখেছে। ওকে কোলে নিলে সেই শিশুকাল থেকে মা'র স্পর্শ পাই। এখনো সকাল-বিকাল কোলে না নিলে ভালো লাগে না। পৌনে আট বছর বয়স এখন। কথায় কুঁড়ির মতো বুড়ি। সারা দিন আঁকাআঁকি নিয়ে ব্যস্ত। হাতের লেখা তার গৃহশিক্ষিকা এম এ ক্লাসের ছাত্রীর চেয়েও ভালো। আমার, ওর ভাইয়া, মা'র থেকে ভালো। কুঁড়ি ল'পড়ে, হাতের লেখা প্রায় তার মতো। রাস্তায় বেরুলে সাইনবোর্ড দেখে সব পড়ে ফেলে। যেটা পারে না সেটা বানান করে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি তার কাছে সহজ। কিন্তু আমি চাই ও বাঙালি হোক। কিন্তু ওর মা তাকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছে।
কারণ ওর ভাইবোন গ্রিন হেরাল্ডে পড়েছে, তাই ওকেও পড়াতে হবে। ওর মা'র কথা বড় হয়ে যদি তার মনে হয় বড় ভাইবোন গ্রিন হেরাল্ডে পড়েছে, সে নয় কেন? আমি অমত করতে পারিনি বা করিনি। আমরা ছেলেবেলায় স্কুলে যেতাম ৪-৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে। কখনো হোস্টেলে থাকতাম একেবারে অতি সাধারণের মতো। কিন্তু আমার কুশিমণি স্কুলে যায় তার ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ি করে। আমার দীপকে কেউ কোনো দিন বসা থেকে উঠতে বলেনি। সেই দীপকে যখন কুশিমণি এটা ওটা হুকুম করে আমি অবাক হই। কুশিমণি দীপকে কিছু বললে তার না নেই। রাত ১২টাতেও বোনের আবদার পূরণে তার ক্লান্তি নেই।
দুই বোনের বয়সের পার্থক্য ১৪ বছর। কুঁড়ি, কুশি যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে তখন মনে হয় ওরা যেন দুই বান্ধবী। এত অল্প বয়সে এত মেধাসম্পন্ন কোনো বাচ্চা দেখিনি। ওর কষ্ট একটাই চট করে রোদের দিকে তাকাতে পারে না। পারবে কি করে? মা'র পেট থেকে পড়ে মাটিচাপা পড়ায় ভালোভাবে দুনিয়ার আলো দেখেনি, অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিল। তাই তো আমার ঘরে এসে আলোয় আলোয় আলোময় করে তুলেছে। কোনো অশান্তি, ঝগড়াঝাটি নেই। ভাইবোনের মারামারি, কাটাকাটি নেই। আমরা যেমন মাকে জড়িয়ে সবাই এক রসুনের কোয়া ছিলাম, এখন কুশিকে জড়িয়ে সেই একই রকম হয়েছি। ছোট ভাইবোনরা কুশিমণির জন্য পাগল। তারা ওকে অসম্ভব আদর-যত্ন করে। মাননীয় মন্ত্রী বড় ভাইকেও দেখি কুশিমণির জন্য উতালা থাকেন। কখনো গেলে বুকে তুলে কি যে যত্ন করেন অভিভূত না হয়ে পারি না।
এযাবৎ বোন রেহানার সঙ্গে যতবার কথা হয়েছে একবারও কুশি প্রসঙ্গ বাদ পড়েনি। তার ছোট মেয়ে অবন্তী বলে যেমন আকুল হয়ে পড়ে তেমনি কুশিমণিকে নিয়ে ভীষণ ব্যাকুল। এ ক'বছরে যে ক'বার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে ছেলেমেয়েদের কথা বলতে গিয়ে সবার আগে কুশির কথা জিজ্ঞেস করেছেন। এক সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার ছেলে দীপকে গোসল করাতেন, খাবার-দাবার সেরে ঘুম পারাতেন। বাচ্চাদের আদর-যত্ন করার একটা বিশেষ গুণ দয়াময় আল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন।
ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কুশি নিয়ে শুরু করেন, কুশি দিয়ে কথা শেষ করেন। দিদি শুভ্রা মুখার্জি তার প্রথমেই কুশির খবর চাই, 'বাঘা, তোমার ছেলেমেয়ে-বউ কেমন? কুশি কেমন?' সেই কুশিমণি হাসপাতালে। আজ অপারেশন, তাই আমার সমস্ত হৃদয়-মন অশান্ত-চঞ্চল, স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। ভাবতে না চাইলেও চোখের সামনে মনের মণিকোঠায় কুশি এসে কড়া নাড়ে। তাই কি লিখব, লিখতে যে স্বস্তি লাগে, বসতে লাগে- সে স্বস্তি বা শক্তি আজ আমার নেই। আধুনিক যুগে চিকিৎসাশাস্ত্র অনেক উন্নত হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া উচিত।
ছোট্ট একটা অপারেশন কিন্তু তবু আমরা কেউ স্থির, অচঞ্চল থাকতে পারছি না। সবার মন চঞ্চল হয়ে আছে। আসলে কুশিমণিই আমাদের ভালোবাসা, কুশিই মানবতা। মানুষ মানুষের জন্য কুশিমণি তার প্রমাণ। অনেকে মনে করে আমাদের বুকে স্থান পাওয়ায় কুশি ভাগ্যবতী। কিন্তু কেন যেন আমাদের মনে হয় কুশিকে বুকে পেয়ে আমরা ভাগ্যবান। সে আমাদের ছায়ায়-মায়ায় জড়িয়ে আছে। কুশি না এলে ভালোবাসার ভয় কাকে বলে বুঝতাম না। মা কষ্ট পাবেন, দুঃখ পাবেন, মন খারাপ করবেন_ সে ভয় পেয়েছি ঠিকই।
কিন্তু এখন দেখছি কুশিমণি অসন্তুষ্ট হবে, পছন্দ করবে না, মন খারাপ করতে পারে সেই ভয় অনেক বেশি। মনে হয় এমনই হয়, কাউকে ভালোবাসলে ভালোবাসার সময় কেটে যায় তরতর করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মা'কে নিয়ে ভারতে থেকেছি অনেক দিন। সে সময় কুশি যদি থাকত দিনগুলো আরও আনন্দের, ছন্দময়, গতিশীল হতো। যদিও ছোট বোন শাহানার মেয়ে ইয়ামনি নির্বাসিত জীবনে ছিল মস্তবড় অবলম্বন। তারপর কোলজুড়ে ঘর আলো করে এলো দীপ। কুঁড়ি এলে ওর ভাগ্যে ভাগ্যবান হয়ে দেশে ফিরলাম। দীপ, কুঁড়িই ছিল আমার ঘরে চাঁদের আলো। এখন কুশিমণি সবার চোখের আলো হয়ে আমাদের জীবন আলোময় করে তুলেছে।
প্রায় ৫-৬ বছর আগে পঙ্গু হাসপাতালে ওর অপারেশন করতে এসোসিয়েটস প্রফেসর আবুল কালাম আজাদের কাছে গিয়েছিলাম। মিষ্টিভাষী অসাধারণ ভালো মানুষ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। এখন ঢাকা মেডিকেলের প্লাস্টিক সার্জারির প্রধান। তার হাতেই এবার কুশিমণির অপারেশন। ৫-৬ বছর আগে যেটা হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়েছিল অধ্যাপক শাফকাতের হাতে। আর আজ হচ্ছে আবুল কালাম আজাদের হাতে। মা ১৫ জুন ভর্তি হয়েছে। রক্ত, এঙ্-রে, এনেসথেসিয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনো কিছুতেই ওহ আহ টু টা করেনি। সেদিন যখন রক্ত নেয় একটু টুঁ শব্দও করেনি। ওখানে ওর মা হলে রক্ত দিতে বাড়ি মাথায় তুলত। বড় বেশি ভালো লেগেছে মামণির এ ক'দিনের চলাফেরা। গতকাল যখন লিখছিলাম মন বসছিল না, কলম চলছিল না। তারপরও পাঠকের কথা চিন্তা করে অগোছালো মনের আবেগ তুলে ধরলাম। মন ভালো না, হাত চলে না- তাই দেশের সমস্যা বলতে ভালো লাগে না।
১৪ জুন ছিল আমার জন্মদিন। সত্যিই ১৪ জুন আদৌ জন্মদিন কিনা জোর দিয়ে বলতে পারব না। কারণ বাবা-মা, আত্দীয়স্বজন মিলে, সর্বশেষ স্কুলের মাস্টাররা যা লিখে দিয়েছেন তাই এখন আমাদের জন্মদিন। নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা মার্কার প্রার্থী শফিকুল ইসলাম দেলোয়ারের প্রচারে গিয়েছিলাম। মানুষের সে যে কি হতাশা বলে শেষ করা যাবে না। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকীর আক্ষেপ, দেশের সব নদ-নদীতে মাছ পাওয়া যায় কিন্তু নারায়ণগঞ্জে পাওয়া যায় মানুষের লাশ।
আসরের নামাজ আদায় করতে বায়েতুল ইজ্জত জামে মসজিদে গিয়েছিলাম। বসেছিলাম বহু দূরে। আসরের নামাজে বেশ সময় পাওয়া যায়। বসে বসে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ পড়ছিলাম। পিছন থেকে হাফেজ আবদুল বাছেত নামে এক ভদ্রলোক এসে বড় আদর করে মিম্বরের কাছে নিয়ে গেলেন। নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে অত মধুর আচরণ খুব একটা পাইনি। বড় ভালো লেগেছে। নারায়ণগঞ্জে যতক্ষণ ছিলাম কখনো স্বস্তি পাইনি। সব সময় বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি, যে পরিবার পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা আদায়ে ভূমিকা রেখেছে, যে পরিবারের এক সন্তান নাসিম ওসমান নববধূ বাসরঘরে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামে আমার সঙ্গে শরিক হয়েছে, তারা আজ এত বিতর্কিত কেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শামীম ওসমানের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন। সব মানুষকে দূরে ঠেলে কি করে তিনি ওসমান পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন? যারা নিহত হয়েছে, সর্বস্বান্ত কাঙ্গাল হয়েছে তাদের কি হবে? এ ক'দিনে শ্রেষ্ঠ খবর ৭ খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন কলকাতায় ধরা পড়েছে। পুলিশ তাকে ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। নূর হোসেন ভারতে ধরা পড়েছে। তার ভারত যাওয়ার কথা আমরা শামীমের কণ্ঠে টেলিফোনে শুনেছিলাম। তারপরও কোনো বিচার হয়নি। মনে হয় ২৬ তারিখ উপনির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের মানুষ নিজেরাই এর বিচার করবে। আবার আরেক আলামত মিরপুরের পল্লবীতে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার লোকেরা ঘরে তালা দিয়ে পেট্রল ঢেলে পুলিশের সামনে আগুন দিয়েছে। তস্করেরা চুপেচাপে খুন-খারাবি করে সেটা ভিন্ন কথা।
কিন্তু পাহারাদাররা খুন করতে যদি উৎসাহ দেয় বা খুনিদের পাহারা দেয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? নূর হোসেন, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার কর্মকাণ্ড বিশ্বকাপকেও ম্লান করে দিয়েছে। দেশের মানুষ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্তি চায়। এতকিছুর পরও কি আমাদের নেতা-নেত্রীদের চোখ খুলবে না? প্রিয় পাঠক, আমার কুশিমণির জন্য দোয়া করবেন। সে যেমন আমার ঘর আলো করেছে, সুস্থ হয়ে হতদরিদ্র দেশবাসীর অন্ধকার ঘরে সে যেন আলো হয়ে জ্বলতে পারে। আল্লাহ তাকে সেই শক্তি দিন, আমিন।
লেখক: কাদের সিদ্দিকী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিক।