উনিশ শ’ একাত্তর-১৪ :সাইদুল ইসলাম
২৫ মার্চ, রাত দশটা। সুবেদার মেজর ইতবারকে ডেকে পাঠিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক হালি শহরে ইপিআর হেড কোয়ার্টারে তার অফিসের সামনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। একটু আগে তিনি ক্যাপ্টেন হায়াত নামে পাকিস্তানি এক অফিসারকে বন্দী করে ওয়্যারলস সেটশনের দখল নিয়েছেন। আশ্চর্য এই অস্থিরতার মধ্যেও ক্ষুধা তাঁকে ভোগাচ্ছে।
রাত সাড়ে আটটায় সারসন রোডের বাড়িতে ক্যাপ্টেন মুসলিমের সাথে তিনি যখন সবে ডিনারে বসেছেন, ঠিক তখনই সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাড়িতে ঢুকেছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ জাফর। কোন ভূমিকা না করে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা, মনেহয় ভেস্তে গ্যাছে, শুনলাম গা ঢাকা দিয়ে এয়ারপোর্টে ভেগেছে ইয়াহিয়া’।ভাতের থালার উপর থেমে গিয়েছিলো রফিকের হাত, – ঢাকা থেকে তো কোন খবর পাচ্ছি না! – ‘খবর পাবেন কি ভাবে? শুনেছি, সন্ধ্যার পরপরই, আপনাদের ওয়্যারলেসের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে চলে গিয়েছে।
রফিকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো, বলেছিলেন, ‘অসম্ভব! আমি বিকেলেও আমার অপারেটরদের ব্রিফ করেছি’। জাফর যখন বললেন ‘আমি এখানকার কথা বলছিনা। ঢাকার কথা বলছি’।নিমেষে পরিষ্কার হয়ে গেলো সবকিছু। ডাক্তার জাফরকে খবরটা ইবিআরসি আর এইটথ বেঙ্গলে পৌছে দিতে বলে তিনি ভাত রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন। গতকাল কর্নেল এমআর চৌধুরি আর মেজর জিয়ার সাথে কথা বলার পর, তিনি সবকিছু আগাগোড়া ভেবেছেন, সিনিয়ারদের কথা অযৌক্তিক মনে হয়নি। ‘দ্য ডায়ালগ ইজ নট ইয়েট ওভার, লেট’স ওয়েট ফর শেখ সাহেব’স ডিসিশন।
কমান্ড্যান্টের সাথে মজিবরের যোগাযোগ আছে, থ্রু ওসমানী’। তবে আজ জাফরের কাছে ঢাকার খবর শোনার পর মনে হলো, নির্দেশের জন্যে আর অপেক্ষা করার কোন মানে নেই। ঝড়ের গতিতে তিনি ওয়্যারলেস স্টেশন দখলে করে নিয়েছিলেন। হালিশহরে, ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করা যে সহজ হবে না, এ তিনি আগেই জানতেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, অবাঙালিদের কিছু বুঝতে না দিয়ে, বাঙালি সৈনিকদের সশস্ত্র রাখতে হবে।
সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আজিজ যখন বিভিন্ন অযুহাতে বাঙালি সৈনিকদের দূরে পাঠিয়ে দিয়ে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অবাঙালি সৈনিকদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন, রফিক তখন কৌশলে কোয়ার্টার গার্ড, কোত, আর গোলাবারুদের আশে পাশে ডিউটিদিয়ে বাঙালি সৈনিকদের সশস্ত্র রাখার চেষ্টা করেছেন। লোকবল যতই থাকুক, অস্ত্রের দখল রাখতে পারলে জিততে কতক্ষণ। আজ রাতেও এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বাঙালি সৈনিকদের বেশি রাখা হয়েছে।
অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ইতবার কে আসতে দেখে তিনি অফিসে ঢুকলেন। সুবেদার মেজরের বয়স হয়েছে। সৈনিকদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি। ঘুম থেকে উঠে আসায় তাঁর চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাবটি বেশ স্পষ্ট। রফিক তাঁকে বসতে বললেন, ‘খুব অসময়ে আপনাকে ডাকতে হলো, এসএম সাহেব’।হাত কচলাতে কচলাতে ইতবার বললেন, ‘কোন ব্যাপার নয় স্যার আমি তো জেগেই থাকি’। রফিক বললেন, ‘শহরের কথা কিছু শুনেছেন?’
ইতবার তার উত্তর পুরোপুরি দেবার আগেই, পাশের রুম থেকে চার জন সৈন্য এসে রাইফেলের বেয়োনেট তার বুকের উপর ধরলো। রফিক শুধু বললেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো, ভাগনেকা কোশিস মাত কারনা’। হতভম্ব হয়েগেলেন সুবেদার মেজর। তাঁর হাত বেধে নিয়ে যাওয়া হলো। একটু পর সিগন্যাল জেসিও, পাকিস্তানি সুবেদার মোবিনকে ডাকা হলো।এর মধ্যে অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।তাদের মধ্যে অনেকেই বুঝতে পেরেছে, তাদের বিপক্ষে কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু অস্ত্রাগার বাঙালিদের দখলে থাকায় কিছু করতে পারছে না।
সুবেদার মোবিন এলেন আতংকিত অবস্থায়। প্রায় সাথে সাথেই মেজর ইকবালের ফোন এলো। ইপিআর ১১ উইং এর পাকিস্তানি অধিনায়ক ইকবাল, রফিককে বললেন, এত রাতে অফিসে কী করো? – গার্ড চেক করতে এসেছিলাম স্যার। – সব ঠিক ঠাক? – জী স্যার? – সিগন্যাল জেসিওকে খবর দিয়েছি সেই কখন, কোন পাত্তা নেই – মনে হয় ঘুমাচ্ছে স্যার, কথা বলবেন? – ফোনটা দাও না! সাথে সাথে মোবিনকে না দিয়ে, রফিক বললেন, ‘আমি ডাকতে পাঠিয়েছি একটু অপেক্ষা করেন’। এর পর সময় কাটানোর জন্যে ইকবালের সাথে একথা সেকথা হতে থাকলো।
এক পর্যায়ে, ইকবাল বললেন, – হায়াতের ফোন কেউ ধরছে না কেন? একটা ছোট্ট ধাক্কা খেলেন রফিক। কিছুক্ষণ আগে তিনি ক্যাপ্টেন হায়াতকে বন্দী করেছেন। বললেন, ‘ওর ফোন খারাপ, এই মাত্র ওর ওখান থেকে এলাম, সুন্দর এক কাপ চা খাওয়ালো’।‘ইয়ার কভি, হামকো ভি লে চলো চায়ে পিনেকে লিয়ে’ মেজর ইকবাল বললেন।
ততক্ষণে সুবেদার মোবিনকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে তাঁকে নিয়ে আসা হলো, রফিক বললেন, ‘মেজর ইকবাল সাহেবের সাথে এখন, ফোনে কথা বলবেন, আমি যা বলবো তাঁর বাইরে একটা শব্দ যেন না শুনি’। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাজী হলেন মোবিন। ক্যাপ্টেন রফিক, নম্বর ডায়াল করে তার কানের কাছে ধরলেন। মোবিন বললেন, স্লামালাইকুম স্যার, সুবেদার মোবিন বলছি – মোবিন সাব, আপকা পাস ঔর কোয়ি হ্যায়?
রফিক, হাত দিয়ে মাউথপিস চেপে ধরে বললেন, বলেন ‘নেই’। সুবেদার মোবিন তাই বললেন। ইকবাল বললেন আমি তো একটু আগে ওনার সাথে কথা বললাম? এবার মোবিনকে শিখিয়ে দেওয়া হল, ‘এই মাত্র এসএম স্যার কে নিয়ে বাইরে গেলেন’। – কোই গড়বড়? – নেহি সাব। খুব অনুগত হয়ে শিখিয়ে দেওয়া জবাব দিলেন সিগন্যাল জেসিও। একে একে অন্য জেসিওদেরকেও বন্দি করা হলো। বন্দী হলো অন্যান্য সকল অবাঙালি সৈনিক।পৌনে এগারটার সময়, বাঙালি সুবেদার জয়নাল জানালেন সব কাজ শেষ হয়েছে। এয়ারপোর্টসহ চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সৈনিক যাবার নির্দেশ দিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক রেলওয়ে হিলের দিকে রওনা হলেন।
সূত্রঃ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, ২৬৭ দিনে স্বাধীনতা, মুক্তি যুদ্ধে ব্যক্তির অবস্থান, রক্ত আগুন, অশ্রু, জল, স্বাধীনতা