যাত্রীবাহী লঞ্চ ও তেল-সিমেন্টবাহী জাহাজসহ আড়াই হাজার নৌযান ডুবে আছে দেশের বিভিন্ন নদীর তলদেশে। দীর্ঘ দিন থেকে এসব নৌযান তলদেশে পড়ে থাকায় নাব্যতা হারাচ্ছে নদী, সঙ্কুচিত হচ্ছে নৌপথ এবং একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যও পড়ছে হুমকির মুখে।
এছাড়া উদ্ধার সরঞ্জামের অপ্রতুলতার কারণে শিগগিরই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে না। আর এ ব্যাপারে ত্বরিৎ কোনো পদক্ষেপও নেই। অথচ ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ৫৩টি নদী খননের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নাব্যতার অন্যতম বাধা ডুবে থাকা বিপুল সংখ্যক নৌযান উদ্ধার না করে খননে এতো টাকা খরচ মানে পুরোটাই অপচয়। এমনটাই মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৭ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত বিভিন্ন নৌ-দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ২৩৯টি নৌযান ডুবে গেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৭ হাজার ৭৭৯ যাত্রীর মৃত্যু ও ২০ হাজার ৬৪৭ জন আহত হয়।
এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম মাত্র ৪৮৬টি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। আর ব্যক্তিগতভাবে উদ্ধার করা হয় ২৯৭টি। এসব নৌযানের মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্ধার সরঞ্জামে সীমাবদ্ধতার কারণেও অনেক নৌযান শেষ পর্যন্ত নদীর তলদেশেই পড়ে থাকছে। যেমন: হামজা ও রুস্তমের মাত্র ৬০ টন ওজনের নৌযান উদ্ধার করার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ডুবে যাওয়া নৌযানের মধ্যে রয়েছে একশ থেকে হাজার টন ওজনের অনেকগুলো জাহাজ। প্রয়োজনীয় উদ্ধারকারী জাহাজ না থাকায় ওই সব নৌ-যান উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই সীমাবদ্ধতার কারণে ডুবে থাকা নৌ-যানে পলি পড়ে সৃষ্টি হয়েছে ডুবোচর। ভরাট হয়ে গেছে নদীর তলদেশ। নাব্যতা নষ্ট হওয়ায় নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, নদীর জীব-বৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদও পড়েছে হুমকির মুখে।
সূত্র জানায়, নদীর তলদেশে ডুবে থাকা ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা দামের এসব নৌ-যান উদ্ধার না করেই সরকার ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নদী খনন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
তবে যত্রতত্র নৌ-যান ডুবে থাকায় সরকারের এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে না বলে মনে করছেন নৌ বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী খনন প্রকল্পে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মংলা বন্দর চ্যানেলে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ডুবে যাওয়া তেল ও সিমেন্ট বোঝাই ৩টি কার্গো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ডুবে থাকা কার্গো থেকে তেল ভেসে বেড়াচ্ছে। সিমেন্টের আস্তর ও বর্জ্যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘হামজা ও রুস্তম উদ্ধারকারী জাহাজ দিয়ে বড় জাহাজ তোলা যায় না। অনাকাঙ্ক্ষিত ও দৈব দুর্বিপাকে নৌ-দুর্ঘটনায় নিমজ্জিত লঞ্চ বা জাহাজ উদ্ধারের লক্ষ্যে ২৮ বছর পর ৩৫৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ২৫০ টন উত্তোলন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে।’ গত বছরের এপ্রিলে জাহাজগুলো কেনার সিদ্ধান্ত হয়, এ বছরের ডিসেম্বরে বহরে যুক্ত হবে বলে জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী আরো জানান, নৌ-যোগাযোগ খাতে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও দু’টি ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পার্সোনেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট সেন্টার (ডিইপিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরই মধ্যে ৪টি মেরিন একাডেমি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নৌ-পথে সার্বিক নিরাপত্তা ও ডাকাতি বন্ধে ‘জলথানা’ গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন নদীতে ডুবে থাকা নৌযান উদ্ধারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক (নৌ-সংক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ ) ও নদী বিশেষজ্ঞ মো. এমদাদুল হক বাদশা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকুলীয় নৌ-পথে নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধারে একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া উচিৎ। ভূতাত্ত্বিক জরিপ করে নিমজ্জিত নৌ-যানগুলোর প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করে দ্রুত উদ্ধারের জন্য প্রাইভেট স্যালভেজ পার্টিকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধার করা হলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক হবে, নৌ-চালচল নিরাপদ হবে, মৎস চাষ ও কৃষিতে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া পরিবেশ উন্নয়নও সম্ভব হবে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।’ উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তমের ডুবুরি দুর্ঘটনাস্থলে পাঠাতে হলে দুইটি গাড়ি ও দুইটি স্পিডবোট সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তত থাকা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
নদী বিশেষজ্ঞ মো. এমদাদুল হকের (বাদশা) নদী, নৌ-যান, নাবিকদের অতীত ও ভবিষ্যৎ এবং নৌ-দুর্ঘটনার ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, চালকদের ভুল-ত্রুটিতে (মাস্টার, সুকানি, লস্কর অর্থাৎ নৌ-যানের ক্রু) শতকরা ৩৪ ভাগ, ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডো ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ২৫ ভাগ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ে ২০ ভাগ, ত্রুটিপূর্ণ নৌ-যানে ১৩ দশমিক ৬৮ ভাগ, যাত্রীদের অসর্তকতায় ০২ দশমিক ৩২ ভাগ,পাইলটদের ভুলে ২ ভাগ ও অপর্যাপ্ত মার্কিয়ের কারণে এক ভাগ নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনের উল্লেখিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাটিয়া নদীর মোহনায় ঘূর্ণিঝড়ে লঞ্চ ডুবে ১৪০ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। লঞ্চটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালে একই জেলার লঞ্চ ডুবে নিহত হয় ৬২৫ জন।
২০০৪ সালে এমভি দীপক ও লাইটিং সান লঞ্চডুবির ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সর্বশেষ ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপার রামদাবাদ নদীতে এমভি শাতিল-১ ডুবে যায়। এসময় ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হলেও এখনো ওই লঞ্চের ৩০ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন।
এর ১১ দিন পর ১৫ মে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে এমভি মিরাজ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে নিমজ্জ্বিত হয়। ৪৫ জন যাত্রী তীরে উঠতে সক্ষম হয় এবং চার দিনের অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৫৭ জনের লাশ। বাকি যাত্রীরা এখনো নিখোঁজ।
তবে বর্তমান সরকারের কঠোর নীতির কারণে নৌ-দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমেছে বলে দাবি করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
এসব লঞ্চ দুর্ঘটনায় আরোহীদের উদ্ধারেও যেমন ব্যর্ততা রয়েছে তেমিন ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরে আর উদ্ধার করা হয়। সেগুলো নদীর তলদেশেই বছরের পর বছর থেকে যায়।
১৯৬৫ থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম প্রায় ৪শ ডুবন্ত নৌ-যান উদ্ধার করে। কিন্তু এ দুটো উদ্ধারকারী জাহাজ ক্ষমতার বাইরে থাকায় বাকি নৌ-যানগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
গত ২০ বছর ধরে হাই পাওয়ার স্যালভেজ শিপ আনার উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে উন্নত দেশে গ্যাব-টাইপ স্যালভেজ শিপ আছে যা দিয়ে তীব্র স্রোতে ডুবুরিদের জীবনের ঝুঁকি ছাড়াই ডুবন্ত নৌ-যান উদ্ধার করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌযানে ‘রিভার্সিবল গিয়ার’ সংযোজন করলে নৌযান সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। ফলে নৌ দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।’