সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় না বসলে ঈদের পর হরতাল-অবরোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে। আজ রোববার বিকেলে জয়পুরহাটে এক জনসভায় খালেদা জিয়া বক্তব্য দেওয়ার সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা হরতাল দেওয়ার দাবি তোলার পর খালেদা জিয়া এ কথা বলেন।
খালেদা জিয়ার জয়পুরহাটের সমাবেশ নিয়ে আমাদের সূত্র জানায় , শহরের রামদেব বাজলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে গোড়ালি-ডোবা পানিতে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আজ রোববার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুখ থেকে আন্দোলনের পরবর্তী দিক নির্দেশনা শোনার অপেক্ষায় প্রকৃতির বৈরিতাকে উপেক্ষা করে মাঠে আসতে শুরু করেন তাঁরা বেলা ১১টা থেকে। বেলা চারটায় মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এই সরকার জবর দখলকারী, অবৈধ সরকার। আসন্ন ঈদের পরে এই সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তেলা হবে। সেই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকুন।’
খালেদা জিয়া ঠিক এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে দলের নেতা-কর্মী ও জেলার সাধারণ মানুষ তাঁর বক্তব্য শুনেছেন। তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েই বক্তব্য শুরু করে তিনি বলেন, ‘দেশে আজ কোনো বৈধ সরকার নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৫ শতাংশ মানুষ অংশ নিয়েছে। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষ আমাদের আহ্বানে সাড় দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাননি। তাই আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রতিনিধি দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতিনিধি নয়। কাজেই সংসদ বাতিল হয়নি। আমরাই এখনো জনপ্রতিনিধি। আমি সরকারেরও প্রতিনিধি নই, বিরোধী দলেরও নই। আপনারা আমাদের কথা শুনেছেন তাই আমি আপনাদের প্রতিনিধি।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন আমাদের এই সরকারকে বৈধতা দিতে বলছে। এর মধ্যে দিয়ে তারা নিজেরাই প্রমাণ করছে তারা অবৈধ।’
তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। বাম-ডান, ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আমরা সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করব। সেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেবে। এবং জনগণকে নিয়েই এই অবৈধ, খুনি, লুটেরা সরকারকে বিদায় করা হবে।’ তিনি বলেন, এই সরকার পদ্মা সেতু, কুইক রেন্টাল, শেয়ারবাজারসহ রানা প্লাজার সাহায্যের জন্য আসা যে টাকা আত্মসাত্ করে সুইস ব্যাংকে জমা করেছে তা নিরপেক্ষ তদন্ত করে লুটেরাদের বিচার করতে হবে। টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমালোচনা করে বলেন দুদক একচোখা কাজ করছে। কেবল বিএনপিকে হয়রানি করে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজদের ধরে না।
র্যাব প্রসঙ্গে
বক্তব্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা র্যাব গঠন করেছিলাম। তখন তারা ভালো কাজ করেছে। বড় বড় জঙ্গিদের ধরেছে। দমন করেছে। এখন র্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। র্যাবকে আওয়ামী লীগ রক্ষীবাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে খুন করানো হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনা, ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমকে গুম করার ঘটনা তার প্রমাণ।’ তিনি র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে বলেন, প্রয়োজনে নতুন করে নতুন সংগঠন সৃষ্টি করা হবে।
ড. ইউনূস প্রসঙ্গ
খালেদা জিয়া বলেন, এই সরকার ভালো মানুষদের সম্মান দিতে জানে না। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়ে জাতিকে গর্বিত করেছেন। অথচ এই সরকার তাঁকে পদে পদে অপমান ও অসম্মান করেছে, আর প্রশংসা করেছে ওসমান, হাজারী, তাহেরদের মতো চিহ্নিত গডফাদারদের। মানুষ এই সরকারের কাছে নিরাপদ নয়।
কৃষি ও কৃষক
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, এই সরকার বিনা মূল্যে সার দেওয়ার কথা বলেও দফায় দফায় সার, বীজ ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। কৃষক কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কৃষকদের উন্নতি হবে না।
অর্থনীতি
দেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, সরকার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুট করে ব্যাংকগুলোকে শেষ করছে। সন্ত্রাস, হত্যা ও চাঁদাবাজির কারণে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশের ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি ও নিরাপত্তা দিতে না পারায় পোশাকশিল্পও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো অবদান নেই। তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছিল। বিএনপি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার দল। শহীদ জিয়াউর রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। বিএনপি আসল মুক্তিযুদ্ধের দল। জিয়াউর রহমান দেশে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রেরও প্রবর্তক। আওয়ামী লীগের জনকই আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেন। জিয়া এসেই বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনা দেন। কাজেই বলা যায় জিয়াউর রহমানই আওয়ামী লীগকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন।
হেফাজত ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা
খালেদা জিয়া বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় শাপলা চত্বরে রাতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। খ্রিষ্টানদের গির্জায় হামলা করেছে। রামুতে বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে হামালা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হতে থাকে। আমরা তাদের সংখ্যালঘু বলি না। আমরা সবাইকে বলি বাংলাদেশি। এসব বাংলাদেশি নিয়েই ঈদের পরে বৃহত্তর গড়ে তুলে এই অবৈধ লুটেরা সরকারকে হটাতে হবে।’ এ সময় মাঠ থেকে ‘হরতাল-হরতাল’ শব্দ উঠলেও তিনি বলেন, ‘সব হবে। আমাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে ঈদের পর হরতাল-অবরোধ হবে।’
এর আগে সভায় বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিএনপির নেত্রীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে। তারেক রহমানসহ দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনকে বলেছেন দেশের লোক ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মেনে নিয়েছেন। এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।
সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির নেতা জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, মঈন খান, মেজর জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মাহবুব উদ্দিন, মিজানুর রহমান, আসাদুল হাবিবসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।