মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা রায় কাল মঙ্গলবার ঘোষণা করা হবে। আজ সোমবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এ দিন ধার্য করেন।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শুনে গত ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে এই মামলার বিচার চলছে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে। গত বছরের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। ওই একই দিনে ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ওই মামলার আপিল নিষ্পত্তি ও রায় কার্যকর হয়ে গেছে।
নিজামীর মামলায় দীর্ঘসূত্রতা
নিজামীর মামলায় দীর্ঘসূত্রতার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এই মামলায় ১৭ মাস ধরে ৩০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় নিজামী একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। গত বছর ওই মামলা বিচারাধীন থাকাকালে নিজামীকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। আরেকটি মামলা সমান্তরালে চলার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটি কিছুটা ব্যাহত হয়।
১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় নিজামীর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হলেও ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপন চলে। এরপর রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসর নেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। ৫৩ দিন এই পদ শূন্য ছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ১০ মার্চ থেকে দ্বিতীয় দফায় সমাপনী যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়, যা গত ২৪ মার্চ শেষ হয়।
এই ট্রাইব্যুনাল এর আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও দলটির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার রায় দিয়েছেন। তিনটি মামলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
১৬ অভিযোগ
নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন প্রভৃতিসহ ১৬ অভিযোগ রয়েছে। একাত্তরের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে ও ৩০-৪০ জন নারীকে রাজাকাররা ধর্ষণ করে। ওই ঘটনায় নিজামীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা রুমী, বদি, জালাল, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন নিজামী। এই অভিযোগে ইতিমধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডাদেশ পেয়েছেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী বাহিনী রাজাকার-আলবদরের ক্যাম্প ছিল। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগমুহূর্তে নিজেদের পরাজয় বুঝতে পেরে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে সেখানে নিয়ে নির্যাতন করতেন এবং হত্যা করে মরদেহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ফেলে দিতেন। আর ষড়যন্ত্র ও উসকানির অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে দেওয়া নিজামীর বিভিন্ন বক্তৃতার মাধ্যমে অধীনস্ত রাজাকার ও আলবদরদের অপরাধ করতে উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছেন।
১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী একাত্তরে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তত্কালীন ছাত্র সংগঠন যার নাম বর্তমানে ছাত্র শিবির) সভাপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, তিনি একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক বাহিনী আলবদরের প্রধান ছিলেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়