দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ কালো টাকার প্রজনন বন্ধে অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা চাইছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করতে। কিন্তু সর্বশেষ বাজেট থেকে স্পষ্ট হলো, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা সরকারের পক্ষে এখনই সম্ভব নয়। তাহলে কোথা থেকে শুরু হবে কালো টাকার প্রজনন বন্ধের কার্যক্রম?
নিঃসন্দেহে, কালো টাকা ও অর্থ পাচার সমস্যার আশু সমাধান জরুরি। কিন্তু আরও জরুরী হচ্ছে, বাংলাদেশে কালো টাকা কিংবা অর্থ পাচারকে অর্থনীতির সমস্যা না কি অপরাধ হিসেবে দেখা হবে তার সুরাহা করা। সিদ্ধান্তে পৌঁছানর আগে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে, কালো টাকা কিংবা অর্থ পাচারের ইস্যুতে ব্যবসায়ীদের অপরাধ মানসিকতা কতটুকু জড়িত আর অর্থনীতি কতটা ও কিভাবে দায়ী? এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করতে পারলেই কেবল কালো টাকার সমস্যার বৃহত্তর সমাধান করা সম্ভব।
কালো টাকা সাদা করার বিপক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, সুযোগ দেওয়ার পর দেশের অর্থনীতির কোন উপকার হয়েছে এমন কোন নজির নাই। বরং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পর দুর্নীতিসহ নানান অপরাধ বেড়েছে। সুশীল সমাজের এই অবস্থানের বিপরীতে প্রশ্ন উঠে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করে দিলেই অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব কি না? বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তা করফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্য মাথায় রেখে হয় না। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশের অভাব, অনিশ্চয়তা, আইনী কাঠামর দুর্বলতার কারণেই অর্থ পাচার হয় বেশি।
বিপরীতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকামীরা বলছেন, বিনিয়োগসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এই সুযোগটি থাকা উচিত। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালে কালো টাকা সাদা করার পক্ষে সুযোগকামীদের এই যুক্তির বিরুদ্ধে প্রচুর তথ্য-প্রমাণ হাজির হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষের জন্যই যুক্তি-পাল্টা যুক্তি আছে।
বাংলাদেশে কালো টাকার আইনগত সংজ্ঞাটি অনেকটাই সরল। সাধারণভাবে কালো টাকা বলতে যে সম্পদের বিপরীতে সরকারকে কর দেওয়া হয়নি তার অর্থমূল্যই কালো টাকা। কিন্তু প্বার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতেই কালো টাকার আইনগত সংজ্ঞাটি অনেক বেশি কঠিন। কেউ অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করলেই তা কালো টাকার আওতার মধ্যে পরে যায়। সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারাই কর বিষয়ক আইন মানে না তারাই কালো টাকার মালিক।
যতদিন পর্যন্ত আইন মানা থেকে সমাজ সম্মিলিতভাবে লাভবান হতে না পারবে ততদিন আইন মানার প্রবণতা তৈরী হবে না। আইন মানা লাভজনক হতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কর বিষয়ক আইন সমাজের সকল অংশকে সম্মিলিতভাবে লাভবান করতে পারছে কি না? এই প্রশ্নটির উত্তর ব্যাপক বিস্তৃত।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের ওপর কর আরোপের পরিমাণকে ব্যবসায় বান্ধব হিসেবে মনে করেন না অনেক ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদ। আবার, শিল্পোন্নয়নের সরকারের ব্যয়ের দক্ষতা, স্বচ্ছতা নিয়েও রয়েছে শত সমালোচনা ও ব্যর্থতা। এই বাস্তবতায় ট্যাক্স ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করবে না এইটাই স্বাভাবিক। ফলে, দেশের ব্যবসায়ীদের অনেকেই ‘কালো টাকার’ মালিক হিসেবে পরিচিত হয়ে পড়েন। এই বাস্তবতায়, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আছে বলে ব্যবসায়ীরা কালো টাকার মালিক হচ্ছেন ব্যাপারটি এমন নয়। বরং কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি বন্ধ করে দিলে মূলধারার অর্থনীতিতে নিজেদের ফিরে পাওয়ার সুযোগটি হারাবে ব্যবসায়ীরা। ফলে, অর্থ পাচারের আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।