মেজর (অব.) সুধীর রন্জন সাহাঃ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিব জেলে থেকেই যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের দলীয় কাউন্সিলে শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালের দ্বিতীয় কাউন্সিলেও শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়।
এই কার্যকরণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করেন। মতভেদের কারণে ১৯৫৬ সালেই ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তরুণ শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সালের দলীয় কাউন্সিলে শেখ মুজিব সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালেই শেখ মুজিব জাতির সামনে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। মুজিবের ৬ দফা বাঙালি জনগণের ম্যান্ডেট পায়। শুরু হয় আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের গ্রেপ্তার-নির্যাতন-হয়রানি। গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমেদসহ দলের শীর্ষ নেতাদের। ৭ জুন পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। হরতালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১১ জন আওয়ামী লীগ কর্মী। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। তিন বছরের বেশি শেখ মুজিব বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকেন।
সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৮-এর শেষদিকে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণ অভ্যুত্থানে। প্যারোলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয় পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তদের মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। ২৩ ফেব্রুয়ারির ছাত্র জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারি করে পুনরায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩১৩ সংসদ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন লাভ করে। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের মোট আসনের ২টি ব্যতিত সকল আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। অন্যদিকে, প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। শুরু হয়ে যায় বাঙালি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুকে।
এরপরের ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই সব ঘটছে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ, ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি। মাত্র তিন বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। একই চক্র তিন মাসের মধ্যে কারাগারের ভিতর হত্যা করে অন্য চার জাতীয় নেতাকে। ১৫ আগস্ট অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয় খুনি চক্র। এরই তিন মাসের মধ্যে রাষ্ট্রীয় একক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে অবির্ভূত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়ার হাতে দেশ থাকে ছয় বছর। পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয় এই ছয় বছরে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল ওই সময়টা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার নানা আয়োজন করেন মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়া।
একসময় মিজান চৌধুরীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগে কোন্দল দেখা দেয়। মালেক উকিলের হাতে দল কোনোভাবে টিকে থাকে। জেনারেল জিয়ার ওপর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ আরও একবার ধাক্কা খায়। কিন্তু ততদিনে কিছুটা হলেও পায়ের নিচে মাটি পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে কাউন্সিলে নেতা নির্বাচন নিয়ে চরম দ্বন্দ্বের মুখে দলের অখণ্ডতা বজায় রাখার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ছয় বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনে থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮১-এর ১৭ মে। শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে হাতে খড়ি দিয়েই দলের সর্বোচ্চ পদটি দখল করতে হয়েছিল বিশেষ বিবেচনার কারণে। প্রথম দিনগুলো শেখ হাসিনার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে ছিল। তিনি রাজনীতিতে একেবারেই নতুন আর অন্যান্য নেতারা সবাই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
সুতরাং প্রথম কয়েক বছর লেগেছে তার দল
সামলাতে এবং রাজনীতি শিখতেই। এভাবেই অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২১ বছর পার করে ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতার স্বাদ লাভ করে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬২ আসন পেয়ে অনন্য রেকর্ড স্থাপন করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম ঘটে মূলত ২০০৮ সালেই। ২০০৮ সালের বিজয়ের পর শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা এবং দলের নেতৃত্বে অনেক পুরনো এবং অভিজ্ঞ নেতা-নেত্রীকে পাশ কাটিয়ে যান। ফলাফলটি ভালো হয় না। ফলে ২০১৪ সালের সরকারে তিনি কিছু পুরনো এবং অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগারকে স্থান করে দেন।
এতক্ষণ বিস্তরভাবে আওয়ামী লীগের ইতিহাসের দিকে সকলকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা করলাম। আওয়ামী লীগের ভিতরের এবং বাইরের মানুষগুলোর জন্য এই ইতিহাসের ধারাটি জানা এবং অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর যে আওয়ামী লীগকে আমরা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে অনুপস্থিত দেখতে পাই, তার কারণ নির্ধারণে ইতিহাসের বিষয়টি অনুধাবনযোগ্য। ২০১৩ সালের ১৫ জুনের চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার ঘটনা এবং এই একই মেয়র প্রার্থীদের ২০০৮ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার রাজনৈতিক কেমিস্ট্রিও আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের শাসনের ফলশ্রুতিতে জনপ্রিয়তায় ধস নামার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হলে তার রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাটি বেড়ে যাবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি জাতীয় জীবনে কোনো মানদণ্ডেই বিচার করার সুযোগ নেই।
আর সেখানেই আওয়ামী লীগের অনুধাবনের বিষয়টি লক্ষ্য করতে হবে। অর্থাত্ চারটি সিটি করপোরেশনর নির্বাচনের সময় তাদের যে জনপ্রিয়তা বা চাহিদা ছিল, তাদের বুঝতে হবে তারা আজও জনগণের ঠিক সেই জায়গাটিতেই আছে।
৬৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ আজ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। এর অন্তর্নিহিত কারণটুকু অনুধাবন করা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল মাত্র তিন বছর। অবশিষ্ট দীর্ঘ সময় সংগ্রাম-আন্দোলনেই কাটিয়েছে। তাই তাদের কর্মীরা সর্বদাই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত ছিল। বিশেষ করে পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। বাড়ির ভাত খেয়ে, পকেটের পয়সা খরচ করে তাদের কর্মীরা তখন শুধু নেতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলন করে গিয়েছে। ঠিক শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগও ১৯৯৬ সালের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ভূমিকায় যেতে পারত।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ততদিনে বাঙালির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা এসেছে। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ আওয়ামী লীগের শক্তি হ্রাস করার যুদ্ধে নানাভাবে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করেছেন। তারই একটি ফলশ্রুতি মিজানুর রহমান দ্বারা দ্বিখণ্ডিত আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না। দলছুট মানুষ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই দুটি কিংস পার্টি। আওয়ামী লীগ ছাড়া সংগ্রামী কর্মী পাওয়া তাদের কঠিন ছিল। তাই তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর নতুন চেহারা দেখার সুযোগ। ছাত্রদের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে নিজ দলে নেয়ার সমস্ত প্রস্তুতিই করেছিল তত্কালীন বিএনপির নেতারা। গ্রেপ্তার-হয়রানি এড়াতে অথবা লোভ থেকে নিজেকে রক্ষা না করতে পেরে আওয়ামী লীগের অনেকেই ভিড় জমালো নতুন দলে। সেই আওয়ামী লীগকে সঠিকভাবে ধরে রাখা শেখ হাসিনার জন্য সহজ কাজ ছিল না। তারপরও সেই দিনগুলোই সম্ভবত আওয়ামী লীগের জন্য ভাল ছিল।
১৯৯৬ সালে নতুন ক্ষমতা লাভের পর ২২ বছরের অভুক্ত নেতাকর্মীরা এই প্রথম বুঝি ভক্ষণের জন্য রুটি আর মাংস পেয়ে গেল। রাস্তাঘাটে যারা এতদিন পায়ে হেঁটে হেঁটে জনসেবা করত, মানুষের সমর্থন আদায় করত, তারা হঠাত্ ক্ষমতায় বসে পাল্টে যেতে লাগল। আওয়ামী লীগের শিক্ষা ছিল আন্দোলন পরিচালনার, রাজপথ দখলের; কিন্তু আওয়ামী লীগ বুঝি প্রস্তুত ছিল না ক্ষমতায় বসার। ক্ষমতায় বসে তাই তারা কিছুটা দিশাহারা হয়ে উঠল। তারা খুব দ্রুত ব্যবসা, ঠিকাদারি, সরকারি সুযোগ-সুবিধা সবকিছু দখলে নিতে মরিয়া হয়ে পড়ল। গ্রামের ত্যাগী কর্মীটাও বেঁকে বসল কিছু পাওয়ার জন্য। কি পেলাম আর কি পাব এমন নতুন খেলায় মেতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের ঐতিহাসিক আন্দোলনমুখী চেহারা হারিয়ে যেতে শুরু করল।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি। বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন সদ্য রাজনীতিতে আসা নেত্রীর কাছে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে গেল। কারণ অনুধাবনে ব্যর্থ হলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগ ততদিনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সরকারের ঠিকাদারি ব্যবসায়। ক্ষমতায় না থাকা সময়ে তাই তারা দলের আন্দোলনে ততটা মনোযোগী না হয়ে বরং যেটুকু আয় করেছিল সেটুকু গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত ছিল। রাস্তার আন্দোলনে ঠিক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আওয়ামী লীগের এমন একটি নড়বড়ে অবস্থার মধ্যেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দু’বছর বাংলাদেশকে শাসন করে গেল। তত্ত্বাবধায়কের সময়ে বেরিয়ে এল বিএনপি সরকারের নানাবিধ অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের দুর্নীতি নিয়ে একটি পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়ে গেল জনমনে।
যেহেতু তত্ত্বাবধায়কের পূর্বে পরপর দুটি টার্মে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তাই তাদেরই নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি জনসমক্ষে প্রকাশিত হলো সবচেয়ে বেশি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচারে বিএনপি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি নেগেটিভ পারসেপশনের সৃষ্টি হলো ভালোভাবেই। আর এই সুযোগের ফসলটি গিয়ে পড়ল আওয়ামী লীগের ঘরে। বিএনপির দুই টার্মের শাসনামলে আওয়ামী লীগের সফল কোনো আন্দোলনের ইতিহাস না থাকলেও এবং আওয়ামী লীগের বিশাল কোনো জনসমর্থনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও নেগেটিভ ভোটে ২০০৮ সালে বিশাল বিজয় ঘটে গিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাটা এমনই। বিশেষ করে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এক দলের নেগেটিভ ভোট অন্য দলের পকেটে পড়ে যায়। কেননা জনগণের কাছে এই দুটি দল ছাড়া তৃতীয় কোনো চয়েস নেই। বাংলাদেশের ভোটারদের এই বিশেষ কেমিস্ট্রি একইভাবে বিএনপির পক্ষে কাজ করেছিল গত চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজপথের আন্দোলন দিয়ে ব্যাপক কোনো জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের প্রতি নেগেটিভ ভোটের জোরে তাদের মেয়র প্রার্থীরা বিশাল বিজয়ের মালা গলায় পড়তে সমর্থন হন। ওই নির্বাচনের কেমিস্ট্রিতে ব্যক্তি কিংবা আঞ্চলিক বিষয় গুরুত্ব না পেয়ে জাতীয় বিষয় গুরুত্ব পেয়েছিল। তাই অধিকতর দুর্বল প্রার্থী দিয়েও বিএনপি বিপুল ভোটে জয় লাভ করে।
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া আর কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সামনে সর্বাপেক্ষা চ্যালেঞ্জ তার দলের দুর্নীতি এবং অতি দলীয় চরিত্র। সরকার পরিচালনার শুরুতে হয়তো শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে ভুল হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের লোকদের হাতে আর্থিক সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেই একে একে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ রাজনীতির কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে সরকারের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি আর ঠিকাদারিতে মনোনিবেশ করার প্রয়াস পেয়েছে। দল হয়তো প্রথমে গুটিকয়েক নেতাকর্মীকে সুযোগ দিতে চেয়েছে। কিন্তু ওই সুযোগ আর সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে থাকেনি।
এক থেকে দুই, দুই থেকে শত, হাজার ইত্যাদি। সকলেই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কিভাবে রাজনীতির নামে অর্থ অর্জন করা যায়। ’৬০, ’৭০ কিংবা ’৮০-র দশকে কোনো ছাত্রনেতা কি কখনও কল্পনা করতে পারতেন, ছাত্রাবস্থায় তার নিজের গাড়ি-ড্রাইভার, বাড়ি থাকবে। কিন্তু এখন শুধু বাড়িই নয় বরং দামি গাড়িও থাকছে যে কোনো ছাত্র নেতাকর্মীর অথবা যে কোনো দলের কর্মীর। তা কিন্তু কোনো গোপন বিষয় নয়। বরং রাজনীতির কিছু কিছু কর্মী-নেতাদের বিশাল অবৈধ সম্পদের খবর অফিসিয়ালভাবেই জানেন যেকোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিংবা দলের প্রধান। কিন্তু বলটি হয়তো দল প্রধানের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
সহজভাবে রশি ধরে টানলেও এখন আর নিজ দলের কারও কারও অবৈধ সম্পদ অর্জনের পথটি বন্ধ করার সুযোগ তার হাতে নেই। আন্দোলনের পথে, জনপ্রিয়তার পথে, সুস্থ রাজনীতির পথে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রধানের জন্য। এই চ্যালেঞ্জটি এখন তার জন্য এতটাই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই রোগটি শুধু তার দলকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে তা নয় বরং এর বিস্তৃতি ঘটেছে সংসদ এবং মন্ত্রিসভাতেও। আওয়ামী লীগের বর্তমান চিত্রে ্বঙ্গবন্ধ কন্যা শেখ হাসিনা অসহায়ের মতো সবকিছু যেন দেখেও দেখতে পারছেন না। তবে তারপরও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি ধারণ করার সক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনারই কেবল আছে।
বাংলাদেশে গত ৬৫ বছর ধরে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলই আছে, যার সংগঠন সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃত আছে। শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এখনও সক্রিয়। এই ঐতিহ্যবাহী দলের ধারেকাছেও নেই অন্য কোনো দল। তবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীর সংখ্যা দিনদিন কমছে এবং ত্যাগী নেতাদের পাশ কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত লোভী নেতারা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার ফলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা মূল সংগঠনের বাইরে ছিটকে পড়ছে।
এমন একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা ছিটেক পড়লে দলের জন্য তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে এবং এর প্রতিকারে বড়রকম রাজনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সরকারের কর্মসূচির ওপর দলের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে নির্ভর করে। বর্তমান সরকারের অনেকগুলো অর্জনের জায়গা আছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথে সরকারের নজরকাড়া সাফল্য আছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু সরকার কিংবা দলের কোনো কোনো ভুলের কারণে অনেক সময় সেই অর্জন হারিয়ে যাওয়ার পথে যাচ্ছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ, ফেনী এবং আরও কিছু স্থানে দলীয় কোন্দলের ফলে হত্যার হাত ধরে সরকার বেশ বদনামের সম্মুখীন হয়েছে। এসব বদনামের কারণে পাবলিক পারসেপশন সরকারের উন্ননের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। সুতরাং বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর হাতে আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগ রূপে। অসাম্প্রদায়িকতার ছাপ দিতে বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছিল। দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানীর মতো বড় মাপের নেতাকে হারাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। তবুও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আওয়ামী লীগকে বিচ্যুত হতে দেননি বঙ্গবন্ধু। সেই আওয়ামী লীগের আজকের অবস্থান হিসাব করতে গিয়ে অনেকেই জামায়াতের মতো একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক জঙ্গি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার গন্ধ খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগের এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বিষয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সুযোগ সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজ থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরে অবস্থান করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব রয়েছে।
আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী এবং দলে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দলকে সুস্থ পথে নেয়ার সাংগঠনিক এবং নৈতিক শক্তি শেখ হাসিনার আছে এটা সবাই মনে করে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের ক্ষেত্রে লৌহ মানবীর ভূমিকা ছিল শেখ হাসিনার। সবকিছু মিলিয়ে তার হাত দিয়েই আওয়ামী লীগের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। তার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই আওয়ামী লীগ আবার বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে পরিণত হতে পারে। আবার দলের নেতাকর্মী রাজপথে আন্দোলনে থাকবে, আবার ছাত্রলীগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরে থাকবে, আবার অতি দলীয়করণের দোষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশাসন বেরিয়ে আসবে- এমনটা একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকেই আশা করা যায়। আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যকে বাঁচানো শুধু একটি রাজনৈতিক দলকেই বাঁচানো বুঝাবে না, বরং পুরো দেশের রাজনীতিকেই বাঁচানো বুঝাবে। কেননা আওয়ামী লীগের ইতিহাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ইতিহাস; আর শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশের ইতিহাস।
লেখক: কলামিস্ট,সাবেক সেনা কর্মকর্তা।