DMCA.com Protection Status
title="৭

ব্যাটারী চালিত রিক্সা নিয়ে তেলেসমাতি কান্ডঃ আওয়ামী.লীগ কার্যালয়ে বসে করা হতো লাইসেন্স ব্যবসা!

দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ ঢাকা rikshaw01-e1404493455450সিটি করপোরেশনের অনুমতি না থাকলেও ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ইজিবাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটি ও ঢাকা জেলা রিকশা মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় পরিষদ। আর এসব সংগঠনের বেশিরভাগেরই কার্যালয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনের বিভিন্ন তলায়।

সহজ সরল রিকশাচালকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কথিত এ লাইসেন্স দুই মাস মেয়াদে দেয়া হয়েছে। ফলে নবায়নের নামে একই জনের কাছে কয়েক দফায় এসব লাইসেন্স বিক্রি করেছে তারা। বিনিময়ে নিয়েছে রিকশা প্রতি ১২০০-১৫০০ টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ ঘোষণা করেন। এসব রিকশা আর রাস্তায় নামতে পারছে না। কিন্তু লাইসেন্স সরবরাহকারী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা এখন চুপ। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। যোগাযোগের জন্য যে অফিসের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছিল সেখানেও তাদের হদিস মিলছে না বলে ভুক্তভোগী রিকশা চালকদের অভিযোগ।

হাইকোর্টের নির্দেশের কারণে অকস্মাৎ কর্মসংস্থান হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যাটারি চালিত রিকশার চালকরা। ছেলে-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। এদের বেশিরভাগই ধার-দেনা ও এনজিও থেকে ‍ঋণ নিয়ে রিকশা কিনেছিলেন। এখন কিস্তির চিন্তায় তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

একদিকে সময় মতো কিস্তি দিতে না পারায় এনজিওকর্মীরা বাড়িতে এসে ধরণা দিচ্ছে, নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। অন্যদিকে পরিবারের খাওয়া-পরার খরচ জোগানোর চিন্তায় হন্যে হয়ে ঘুরছেন তারা।

বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য মতে, ৪০ হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশা চলতো। হাইকোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর লক্ষাধিক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে এবং আকস্মাৎ কর্মসংস্থান হারিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

রিকশা চালকদের অভিযোগ, লাইসেন্সের নামে তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা নিলেও বিপদের দিনে ওইসব সংগঠনের নেতারা এগিয়ে আসছে না। তাদের মোবাইল ও অফিস বন্ধ করে উধাও হয়ে গেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি দলের নেতাকর্মী। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এই অপকর্ম করছে।

রিকশা চালকদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, আদায়কৃত এ টাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সরকারি দলের নেতাদের পকেট পর্যন্ত যেত। এ কারণেই সিটি করপোরেশনের অনুমোদন না থাকলেও এসব ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে রিকশাগুলো রাস্তায় চালতো এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পুলিশ ডিস্টার্ব করতো না। তবে মেয়াদ শেষ হলেই শুরু হতো হয়রানি। ফলে তারা লাইসেন্স নবায়ন করতে বাধ্য হতেন।

এই লাইসেন্স দিয়ে এখন কী করবেন খোকন মিয়া। ছবি: অপূর্ব

খোকন মিয়া নামের এক রিকশা চালক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুই মাস আগে ঢাকা জেলা রিকশা মালিক সমবায় সমিতি লিমিডেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে ১২শ টাকা নিয়ে একটি টোকেন (নম্বর প্লেট) দিয়েছে। একই সঙ্গে আমাকে হাইকোর্টে করা একটি রিটের ফটোকপিও দিয়েছে। এটা পুলিশকে দেখিয়ে রিকশা চালাতে বলা হতো।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বায়ক ও শ্রমিক নেতা আবদুল কুদ্দুস দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা ইনছুরসহ কতিপয় নেতা টাকার বিনিময়ে ব্যাটারি চালিত রিকশাকে রাস্তায় চলার অনুমোদনের নামে একটি করে টোকেন দিয়ে টাকা নিয়েছেন।’

বাংলাদেশ শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংগঠক মঞ্জুর মঈন দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিনটি শ্রমিক সংগঠন ব্যাটারি চালিত রিকশাকে অবৈধ রুট পারমিটের নামে দুই মাস মেয়াদী কয়েক দফায় টোকেন বিক্রি করেছে। আর এগুলো হয়েছে দালাল চক্রের সঙ্গে প্রশাসনের যোগসাজশে। এ কারণে বিভিন্ন সময় আমরা এর বিপক্ষে আন্দোলন করলে পুলিশ আমাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছে।’

ব্যাটারি চালিত রিকশার পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও ঢাকা সিটি রিকশা শ্রমিক লীগের সভাপতি আজাহার আলীর সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের চতুর্থ তলায় সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয়ে।

তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারি চালিত রিকশার পক্ষে আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু গতকাল (বৃহস্পতিবার) মহামান্য হাইকোর্ট আমাদের বিপক্ষে রায় দিয়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আমরা সরকারি দলের লোক হওয়ার কারণে কঠোর কোনো কর্মসূচি দিতে পারছি না। তবে অন্য কোনো সংগঠন আন্দোলন করলে আমরা তাদের সঙ্গে থাকবো। তার পরও আমাদের আন্দোলন থেমে থাকবে না। আগামী রবি-সোমবার কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ অস্বীকারে করে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কাজ করিনি। তবে মুগদা স্টেডিয়াম এলাকার ফজলু নামে একজন ১২০০-১৫০০ টাকার বিনিময়ে টোকেন দিয়েছে।’

নিজের কথা অস্বীকার করলেও তার সংগঠনের (জাতীয় রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক লীগ ও ঢাকা সিটি রিকশা শ্রমিক লীগ) সাধারণ সম্পাদক ইনছুর আলী ‘বাংলাদেশ ইজি বাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটি’র নামে টাকা নিয়ে নম্বর প্লেট বিক্রি করেছে বলে আজাহার আলী স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি ইজি বাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির নামে তিন মাসের জন্য লাইসেন্স প্রতি ৫০০ টাকা নিয়েছেন।’

ইনছুর বাংলাদেশ ইজিবাইক শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এ সংগঠনের অফিসও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ৬ষ্ঠ তলায়। তবে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে বার বার ইনছুর আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের চতুর্থ তলায় জাতীয় রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক লীগ ও ঢাকা সিটি রিকশা শ্রমিক লীগের কার্যালয়ে বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান মালিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ নামে দু’টি সংগঠনেরও কার্যালয়, যারা ব্যাটারি চালিত রিকশার বিপক্ষে আন্দোলন করেছিল। এমনকি একই ব্যক্তি এরকম একাধিক সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এদিকে টোকেন (ভুয়া লাইসেন্স) দেয়ার কথা স্বীকার করলেও টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন ঢাকা জেলা রিকশা মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ফজলু। তিনি  বলেন, ‘দুই মাস মেয়াদে সংগঠনের সদস্যদের টোকেন দিয়েছি। যে কয়দিন মেয়াদ ছিল তারা সে কদিন ব্যাটারি চালিত রিকশা চালাতে পেরেছে। তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেয়া হয়নি। তাদের পরিচয় পত্র দেয়া হয়েছে।’

রিকশা বন্ধ পেটে ভাত নেই চালকদের। ছবি: অপূর্ব

সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া কীসের ভিত্তিতে পরিপয়পত্র দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রিকশা হিসেবে সিটি করপোরেশন তো তাদের একটি লাইসেন্স দিয়েছেই। আমরা যেটি দিয়েছি সেটি হলো সংগঠনের পরিচয়পত্র।’

উল্লেখ্য, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সব ধরনের ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশা চলাচল অবৈধ ঘোষণা করে গতকাল বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!