DMCA.com Protection Status
title="৭

নিষিদ্ধ পলিথিনে দেশ সয়লাবঃদিনে প্যাকেজিং কারখানা,রাতের অন্ধকারে পলিথিন কারখানা

polythene02দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে ক্ষতিকর পলিমার রাসায়নিক পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু ১২ বছর আগে এ আইন করলেও বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণের সঠিক কৌশলের অভাবে এখনো নানাভাবে দেদারসে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কিছুটা গোপনীয়তা অবলম্বন করা হলেও ব্যবহার হচ্ছে একেবারে প্রকাশ্যে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন করছে রাজধানীসহ সারাদেশে সহস্রাধিক পলিথিন কারখানা। প্যাকেজিংয়ের নামে লাইসেন্স নিয়ে ওইসব কারখানা অবৈধ পলিথিন উৎপাদন করছে। দিনে প্যাকেজিংয়ের পলিথিন উৎপাদন করলেও গভীর রাতে শুরু হয় অবৈধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন। আর তা ভোরের মধ্যে বিভিন্ন এজেন্টের কাছে পৌঁয়ে দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য মতে, প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হয়, যা একবার ব্যবহৃত হয়। পলিথিনের কারণে ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি অতি দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় এবং পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার জন্য পলিথিনকেই দায়ী করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। পরিবেশবিদরাও পলিথিনকে দেশের কৃষি ক্ষেত্রের হুমকি মনে করছেন।

সূত্র জানায়, রাজধানীতে গড়ে ওঠা কারখানারগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পলিথিন কারখানা রয়েছে। এর বেশিরভাগই রয়েছে ইসলামবাগ এলাকায়। এছাড়া বুড়িগঙ্গার তীরে, রহমতগঞ্জ, লালবাগ, হোসেন উদ্দিন দ্বিতীয় লেন, আমলি গোলা, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় অর্ধশতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে। এ কারখানাগুলোকে কেন্দ্র করে বড় ও শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে বলে জানা গেছে। এ কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে কারখানার মালিকরা। পুরানঢাকা ছাড়া রাজধানীর মিরপুর, কাওরানবাজার, তেজগাঁও, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, নারায়ণঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গীতে বেশ কয়েকটি অবৈধ পলিথিন কারখানা রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন পণ্য প্যাকেজিংয়ের জন্য লাইসেন্স নিয়ে অধিকাংশ কারখানা অবৈধভাবে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করে। সাইনবোর্ড দেখেও বুঝার উপায় নেই এখানে পলিথিন উৎপাদন হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে দিনের বেলায় নামমাত্র প্যাকেজিংয়ের কাজ করলেও মূল কাজ পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কারখানাগুলোর চেহারা পাল্টে যায়। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলে পলিথিন উৎপাদন। পরে তা ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ স্টিকারযুক্ত গাড়িতে করে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।

পলিথিন পরিবেশের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক তাই ২০০২ সালে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। আইন অনুযায়ী, কেউ পলিথিন উৎপাদন করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ্ণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পুনরায় একই অপরাধ করলে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ড অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

polythene04 {focus_keyword} দিনে প্যাকেজিং রাতে পলিথিন কারখানা polythene04

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০২ পাস হওয়ার পর কয়েক বছর সরকার পলিথিন উৎপাদন বন্ধে কঠোর থাকলেও পরবর্তীতে এ বিষয়ে নজর নেই। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণে বর্তমানে সব জায়গায় অবৈধ পলিথিনে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রকাশ্যেই ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ।

আর সহজে পচে না বলে যত্রতত্র পলিথিন ফেলার কারণে শহরের সুয়ারেজগুলো বন্ধ হয়ে বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। বুড়িগঙ্গা দূষণের বড় কারণ এসব পলিথিন। বিশেষ শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী, খাল ও জলাশয়গুলো এই পলিথিনের কারণেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

তবে অবৈধভাবে পলিথিন উৎপাদনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি আবু মোতাবেল। প্যাকেজিংয়ের লাইসেন্স নিয়ে গোপনে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘দোকান ও কারখানা মিলে প্রায় ৪শ থেকে ৫শ প্যাকেজিং কারখানা রয়েছে। কেউ কেউ বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেট তৈরির জন্য পলিথিন উৎপাদন করলেও কেউই পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করেন না। কারা রাতের আধারে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করে তাদের সম্পর্কে আমি কিছু্ জানি না।’

তবে বিভিন্ন দোকানের বিক্রেতারা পলিথিনের বিকল্প কিছু না থাকাকে এই অবৈধ ক্ষতিকর পলিমার রাসায়নিক সারা দেশে এখনো ব্যাপক ব্যবহারের কারণ বলে মনে করেন।

কাওরান বাজারের একাধিক বিক্রেতা দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ জানি, কিন্তু বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের পলিথিনেই জিনিস দিতে হয়। এটা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কারণ বেশিরভাগ ক্রেতা বাজার করতো ব্যাগ নিয়ে আসেন না।

২০১০ সালে পলিথিনের বদলে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের আইন পাস করা হলেও তার কোনো কার্যকরী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। পাটকে কোনোভাবেই জনপ্রিয় করে তুলতে পারেনি সরকার। এমনকি এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। পাটের ব্যবহারকে উৎসাহিত না করার কারণে এ শিল্পটিও প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বাজারের ফিরে এসেছে অবৈধ ক্ষতিকর পলিথিন।

কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী রহিদুল ইসলাম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারের উদ্যোগের অভাবে পলিথিন ব্যাগ আবারও বাজার ছেয়ে গেছে। শুনেছিলাম, সরকার নাকি পাটের ব্যাগ তৈরি করবে সেটাও হলো না। তাহলে আমরা কী করবো। ব্যাগ না দিলেও ক্রেতারা পণ্য কিনতে চায় না।’

polythene03 {focus_keyword} দিনে প্যাকেজিং রাতে পলিথিন কারখানা polythene03 e1404923823328

পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন। তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রশাসন ও সরকারের উদ্যোগের অভাবে পলিথিন ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। পলিথিনি নিষিদ্ধ আইন যথাযথ ব্যবহার করা হয় না। আমাদের পক্ষ থেকে বার বার সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তাগিদ দিলেও তাতে কাজ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আজ অবৈধ পলিথিন উৎপাদনকারী ১০টা কারকাখান বন্ধ করে, অন্যরাও পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করবে।’

তবে অবৈধ পলিথিন উৎপাদনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে দুষলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ( ঢাকা মহানগর) মুহম্মদ মউদুদ উর রশীদ সফদার। তিনি দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্যাকেজিংয়ের নামে অবৈধ পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা খুব সীমিত। আর এসব অবৈধ কারখানার দায় কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের। তাদের উচিৎ হবে যথাসময়ে শিল্প শুমারি করা। এটি করলে এসব কারখানা থাকবে না।’

পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের উদাসীনতার কারণে পলিথিন পুরোপুরি মার্কেট থেকে সরানো যাচ্ছে না পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল, অবরোধের কারণে অভিযান একটু কমে গিয়েছিল। তবে আবার অভিযান শুরু হয়েছে। এছাড়া আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আইনি দুর্বলতা, লোক বল ও পর্যাপ্ত পুলিশের অভাবে অভিযানে ধীরগতি ছিল।’

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!