দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুসন্ধানঃ নিজের ক্রিকেট প্রতিভা ও আর্থিক সামর্থ্যের কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়া-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ চক্রের হর্তা-কর্তা কয়েকটি চৌধুরী-খান-রহমান পরিবারের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিলেন সাকিব আল হাসান। এই হর্তা-কর্তারা বাংলাদেশের ক্লাব পর্যায়ের খেলা থেকে শুরু করে বিসিবি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। এরাই ঠিক করেন কারা বিসিবির সভাপতি-পরিচালক হবে।
পরবর্তীকালে এরাই আবার বিসিবির সভাপতি-পরিচালক এমনকি সাবেক খেলোয়াড়দের আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের বাগে রাখেন। এমনকি, বিসিবির ক্ষমতাসীনদের বিরোধীরাও এই পরিবারগুলোরই আত্মীয়-স্বজন। এই গুটিকয় পরিবারের হাতেই আবার বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ার মালিকানা কিংবা তাদের রয়েছে চরম প্রভাব।
এ কারণেই আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলমান ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে আবারও নানান ষড়যন্ত্র ও শত্রুতার জালে ফেঁসে যেতে পারেন সাকিব আল হাসান। এবং সাকিব আল হাসানকে ষড়যন্ত্রের জালে ফাঁসিয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও বোর্ডের কর্তারাই। আর আশু ষড়যন্ত্র ও বিপদের দিনে সাকিব আল হাসান সঙ্গে পাবেন না মূলধারার কোন মিডিয়াকে।
আইপিএল, বিগব্যাশ, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট লীগ ও কাউন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয় তারকার নাম সাকিব আল হাসান। এই সব লীগগুলোতে সাকিবকে দিয়েই বাংলাদেশকে চেনে ক্রিকেটমোদীরা। ক্রিকেট বাণিজ্যের এই সব লীগে ভাল করে নিজের আর্থিক সামর্থ্যকে বাড়িয়ে তুলেছেন সাকিব। আর সাকিব আল হাসানের আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি ক্রীড়া-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা পুরো খান-চৌধুরী-রহমান চক্রকেই ভেঙ্গে দিতে পারত।
এমনকি আইপিএল মাতানো সাকিব আল হাসানের পক্ষে বলিউডের শাহরুখ খানের মতো পুঁজিপতিদের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে বাংলাদেশের ক্রীড়া-বাণিজ্য পুরো এলোমেলো করে দিতে পারেন এমন আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছিল। একারণেই, সাকিবকে শাস্তি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার অর্থ আয়ের উৎস যতদূর সম্ভব ছেঁটে ফেলা। খোলা চোখে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও সাকিব আল হাসানের ওপর বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করাও নিষিদ্ধ করা হয়। একই কারণে দেড় বছরের জন্য আইপিএল-বিগব্যাশে খেলার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবির খান-চৌধুরী চক্র।
সম্প্রতি অনলাইনবাংলা ডট নেট নামের একটি পত্রিকায় সাকিবকে ছয়মাস নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নেপথ্যের রহস্য প্রকাশ করে দেয়। সংবাদটি সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুললেও বক্তব্যটি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থেকে যায় পাঠকদের। পত্রিকাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আরও অনুসন্ধান চালায় দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ।
দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে, সাকিবকে নিষিদ্ধ করার পেছনে বিসিবি সভাপতির ব্যবসায়িক স্বার্থ ও আকরাম খানের পেশাদারি স্বার্থের বিষয়টি। অনলাইনবাংলা ডট নেট পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫ জুন ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশের তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচের খেলা দেখতে গিয়ে সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরকে ইভটিজিং করে পাপনের বন্ধু ও ব্যবসায়ী বজলুর রহমানের ছেলে রাহিদ রহমান ও চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে রহিম চৌধুরীর ছেলে। সাকিব খেলা চলাকালেই ভিআইপি গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে গিয়ে নিজ স্ত্রীকে অপমান করার ঘটনার প্রতিবাদ জানান। পরবর্তিতে পাপনের বন্ধু ও ব্যবসায়ী বজলুর রহমানের ছেলের বিরুদ্ধে মামলাও করেন সাকিব।
এরপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহল মামলা তুলে নিতে অনুরোধ করলেও সাকিব তা শোনেননি। তখন সাকিব সম্ভবত বোঝেননি, এর পরিণতি কি হতে পারে। সাকিব হয়তো জানতেন না, এই চৌধুরী-খান-রহমান সাহেবরাই বিসিবির অঘোষিত হর্তা-কর্তা। ব্যবসায়ী বজলুর রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ট। সাকিব আল হাসানের স্ত্রীকে অপমানকারীদের মধ্যে ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলের নামেও। ফজলে রহিম চৌধুরী ও সালমান এফ রহমান পরস্পর-পরস্পরের সাথে ব্যবসায়িক-পারিবারিক-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আর সালমান এফ রহমানের বদান্যতাতেই নিজের বর্তমান সাম্রাজ্য তৈরী করেছেন বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
বেক্সিমকো গ্রুপের সহায়তাতেই ২০০৮ সালে দেশের জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেডের ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন পাপন। যার ফলস্বরূপ বিসিবির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পেরেছেন তিনি। কেবল ক্রিকেট প্রশাসক তৈরিতে নয়, নাজমুল হাসান পাপনের জীবনে বেক্সিমকো গ্রুপের অবদান আরও গভীর। পাপনকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। এছাড়া, বেক্সিমকো ক্রিকেট টিমের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি বেক্সিমকো গ্রুপেরই শাইনপুকুর সিরামিক্স লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
তবে চৌধুরী পরিবারগুলো কেবল বিসিবি সভাপতিকে নয় বিসিবি পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান আকরাম খানকেও নানান ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়া দিয়েছে। আকরাম খানকে নিজেদের বাগে রাখতে নানান ব্যবসায় অংশীদারিত্ব দিয়েছে এই চৌধুরী পরিবারগুলো। এমনকি, পাপন নিজেই প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে পদত্যাগ করা আকরাম খানকে বিসিবির পরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার পেছনে কলাকাঠি নেড়েছেন।
আর সেই আকরাম খানই সাকিবকে ওয়েস্টইন্ডিজ খেলতে যাওয়ার বিষয়ে মৌখিকভাবে অনাপত্তি দিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পরে সাকিবকে অনাপত্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছিলেন। আকরাম খানের সেই আশ্বাসের ফাঁদে পড়েই নিষিদ্ধ হয়েছেন সাকিব আল হাসান।
বিসিবিতে নাজমুল হাসান পাপনদের যে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো আছে, সেগুলোও সাকিব আল হাসানের শত্রুদের আত্মীয়। নাজমুল হাসান পাপনদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীগ্রুপ হচ্ছে সাবের হোসেন চৌধুরী। সাবের হোসেন চৌধুরীও আবার ফজলে রহিম চৌধুরীর ভাগ্নে। ফলে, বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে সাকিবের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য থাকছে না কেউই।
বোদ্ধারা বলছেন, আবাহনী লিমিটেডের রাজনীতিও জড়িয়ে আছে সাকিবের ভাগ্য নির্ধারণে। ঢাকার ক্লাব-পলিটিক্স তথা চৌধুরী-রহমান দ্বন্দ্বের বলী সাকিব আল হাসান। নিজেদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে না করে প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করার ঘটনাও গেছে সাকিবের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে সাকিবের সামনে মহাদুর্দিন।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই চৌধুরী-খান-রহমান পরিবারের শত্রুতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকেই মুছে যেতে পারে সাকিব আল হাসানের নাম।