বাংলাদেশের ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার সীমানা হাতছাড়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটি মনে করে এই রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ভারতের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের ঘোষিত রায়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় দলের সহসভাপতি ও সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী এম হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এই অভিযোগ করেন। রাজধানীর গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির পক্ষে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত রায়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে তিনি বলেন, এই রায়কে সরকার রাজনৈতিক রং দিচ্ছে। এটি কোনো জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রতিনিধি না থাকায় সমুদ্রে আমাদের ন্যায্য সীমানা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দক্ষিণ তালপট্টি হাতছাড়া হয়েছে। সরকারের কাছে স্বচ্ছভাবে রায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করেন বিএনপির এই নেতা।
আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ের ওপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার সমুদ্র বিজয়ের যে কথা বলেছে, তা সঠিক নয়। মায়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণেও তারা (সরকার) একই রকম কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ওই সময়ে আমরা কয়েকটি গ্যাস-তেল ব্লক হারিয়েছি। এবারও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ১০টি ব্লক পাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সহকারে সরকারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করছি।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের বিষয়ে তিনি বলেন, এই দ্বীপটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জিয়াউর রহমান আমলে এই দ্বীপটির মালিকানা দাবি তোলা হয়। তিনি (জিয়া) এই দ্বীপের মালিকানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়েছিলেন। ওই সময়ে ভারতও এই দ্বীপের দাবি জানিয়েছিল। এ নিয়ে দুই দেশের যুদ্ধজাহাজও সেখানে গিয়েছিল। সরকারের এই দ্বীপটির অধিকার ছেড়ে দেয়া উচিত হয়নি।
চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, সালিশ আদালতের রায়ের বড় পরাজয় ঘটেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থল সীমা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে আমাদের সর্বদক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার প্রায় ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে সরে এসেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা রেফারেন্স হিসেবে তালপট্টি দ্বীপের দাবিটি সঠিকভাবেই উপস্থাপন করেছিল। এ ক্ষেত্রে তারা যে ম্যাপটি ব্যবহার করেছিল, তা ছিল ১৮৮০ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে জরিপের ভিত্তিতে তৈরি ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল চার্ট। বাংলাদেশ একটি ভুল তথ্য দিয়েছিল যে, এটি ১৯৩৩ সালের তৈরি। এই ভুল তথ্যের কারণে এই ম্যাপটির বদলে ১৯৪৭ সালের কাছাকাছি সময়ের কোনো মানচিত্র বা এরিয়াল ফটোগ্রাফ চেয়েছিল। এটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সরবারহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
হাফিজ দাবি করেন, বাংলাদেশ চাইলে ১৯৫৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর তৈরি টপোমানচিত্র সরবারহ করতে পারত, যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখানো আছে, রেডক্লিফের বিভাজন রেখা হাড়িয়াভাঙা নদীর মধ্যরেখায় অবস্থিত তালপট্টি হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহনাতেই শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, হাড়িয়াভাঙা প্রবাহের চেয়ে রায়মঙ্গল নদীর প্রবাহ অনেক বেশি। তা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নদী। এটি রায়মঙ্গল প্রবাহের সঙ্গে যমুনা নদীর প্রবাহ যোগ হয়েছে। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা কোনোভাবে রায়মঙ্গলের মধ্যপ্রবাহ হতে পারে না। অথচ রায়ে মধ্যপ্রবাহ ধরা হয়েছে রায়মঙ্গলকে। এটি সঠিক নয়।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল খোরশেদ আলমের বক্তব্য সঠিক নয় বলে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপির অপর সহসভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী দাবি করেন। তিনি বলেন, তারা বলেছেন, তালপট্টি দ্বীপের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এটি ম্যাপে নেই— এই বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, দক্ষিণ তালপট্টি আছে, এটি ১৯৭৫ সালের ম্যাপই প্রমাণ করে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এ সংক্রান্ত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ সাহেব ওই সময়ে নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। তিনি নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে তালপট্টিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে একটি লাইট হাউসও স্থাপন করা হয়েছিল। এখন তিনি ভিন্ন কথা বলছেন।
আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়নি অভিযোগ করে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভারতের পক্ষে সে দেশের বিচারক পিএসরাও নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ আমাদের পক্ষে দেশের কোনো বিচারক নয়, ঘানার নাগরিক বিচারক টমান মনশাকে নিয়োগ দেয়া হয়। পিএসরাও ভারতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কয়েকটি নো অব ডিসেন্টও দিয়েছেন। আর বাংলাদেশের পক্ষের বিচারক কোনো নোট-অব ডিসেন্ট দেননি।
তিনি বলেন, ‘কেবল তাই নয়, এই মামলায় ভারতের সমুদ্র বিশেষজ্ঞ ও অ্যাটর্নি জেনারেল অংশ নিয়েছেন। আর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল অংশ নেননি। ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ এবং সাবেক সচিব কে এস মোর্শেদের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সালে মে মাসে সরকার ইউএনসিএস বডিতে বঙ্গোপসাগরের মহিসোপানের নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিল। ওই বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ার আগে আবেদন প্রত্যাহার করে ওই বছরের জুলাই মাসে সরকার হেগে আরবিট্রেশন কাউন্সিলে যায়। এখন আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর আবার কেন আমরা ইউএনসিএসে ফেরত যাচ্ছি। কারণ এই সালিশ আদালতের পর আপিলের কোনো সুযোগ নেই।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে নেয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন বলেন, এ সময় বিএনপি সরকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা মেরিটাইম সেল, দক্ষ জনবল নিয়োগ, একটি আলাদা ভবনসহ বিশেষজ্ঞদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। যাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, নৌবাহিনী, জরিপ অধিদপ্তর, স্পার্সোসহ ৭টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। ওই সময়ে সমুদ্রের বিষয়ে কোনো প্রকৃত তথ্য ছিল না।
তিনি আরও বলেন, কেবল তাই নয়, সে সময় সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে জরিপও চালানো হয়েছিল। অথচ বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো এ বিষয়ে কোনো কাজ করেনি। এটি সঠিক নয়।
তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বৈদেশিক কূটনীতি প্রতিবেশী দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে। সেজন্য রায়ের বিষয়ে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাই। তাই সরকারের কাছে দাবি থাকবে, বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে জাতীয় সম্পদ আহরণ ও রক্ষায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক। এ বিষয়ে আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে চাই। দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও ইনাম আহমেদ চৌধুরী এই রায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।