গত কয়েক দিন যাবৎ মনটা এতই খারাপ যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিছু মানুষের মানসিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাটা একটা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তখন তার আর বোধশক্তি থাকে না: বলার, শুনার বা অনুধাবন করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তার আর দেখার ক্ষমতা থাকে না বা দেখতে চায় না, তারপরও দেখতে হয়। গাজায় শতাধিক লাশের সাথে কয়েকটি শিশুর লাশের ছবি এতটা বিভৎস যে, মনে হয় পরম করুণাময়ের নিকট প্রার্থনা করি যে, আমার দৃষ্টিশক্তিটা কেড়ে নিতে পারতো এই দৃশাটা দেখার আগে। এমনিতে ইবাদত বন্দেগিতে থাকাটা আজকাল আর হয় না, আমাদের ইমানী শক্তি আজ দুর্বল। আমাদের বিবেক আর আর জাগ্রত নেই, ঘুমের ঘোরেই থাকে আমাদের বিবেক।
কিন্তু কখনও কখনও সেটা জাগ্রত হয়। অহর্নিশ জ্বলতে থাকে, আবার পাশান হৃদয় সেটা উপভোগ করতেও ব্যস্ত থাকে। গাজায় যে ইতিহাসের বর্বরতম হামলা চালানো হলো তা-ই নয় সেখানে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হলো। তা বলাই বাহুল্য অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজগুলোর সবগুলোই ফিলিস্তিনের ওপর ঘটাচ্ছে ইসরায়েলিরা। ইহুদিদের আমরা চিনি বা জানি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। হিটলার যখন তাদের হত্যার মিশনে নেমেছিলেন তখন বন্দুকের গুলি খরচ করতে চাননি। হিটলারের কাছে বন্দুকের গুলির চেয়ে ইহুদিদের মূল্য অনেক কম হওয়ায় তিনি গ্যাস চেম্বার বানিয়েছেন। তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল বিরুদ্ধ শক্তির সামর্থ্য, শক্তির কাছে।
কিন্তু ইতিহাস তাকে যতটা নির্দয় ভাবুক না কেন যুগ যুগ ধরে তিনি আলোচনায় এসেছেন তার কৃতকর্মের কারণে, তার কুখ্যাত মহান (!) উক্তি, ‘আমি সকল ইহুদিকে হত্যা করিনি কারণ কিছু বাঁচিয়ে রেখেছি যাতে তাদের কর্মকাণ্ডে মানুষ বুঝতে পারে কেন তাদের হত্যা করার জন্য আমি এত নির্দয় হয়েছি’। ইসরায়েলিরা বুঝি হিটলারের এ উক্তিটাই প্রমাণ করছে!
সেই ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনীরা নিজভূমি থেকে বিতাড়িত। কয়েক দশক ব্যাপী একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে আসছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নিজেদের দেশেই পরবাসী হয়ে থাকতে হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান করার চেষ্টাটি মার্কিন আধিপত্যে আলোর মুখ দেখেনি। সে যুদ্ধটিকে পশ্চিমা মিডিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের যুদ্ধ বলে অপপ্রচার চালিয়েছে।
অন্যদিকে ব্রাজিলে ফুটবল মহাযজ্ঞে মাতোয়ারা এশিয়া, ইউরোপ, পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর সব দেশই। এই আনন্দে মাতোয়ারা সাড়া বিশ্ব সেখানে নায়করা গুটিকতক হলেও তাদের আনন্দ সবাই উপভোগ করতে চায়। সেই মেসি, ওজিলে মাতোয়ারা আমরা সবাই। এই আনন্দযজ্ঞের খবর প্রচারে ব্যস্ত আমাদের মিডিয়া, পাশ্চাত্যের মিডিয়া, আমরা সাংবাদিকরা। আজ আমরা অন্ধ হয়ে গেছি তাই গাজার ভয়াবহতা আমাদের চোখ স্পর্শ করে না, আমাদের কান সেই ক্রন্দন শোনে না। আমাদের ইমানী শক্তি, মনুষ্য শক্তি, মানবতা, আমাদের বিবেক আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
পশ্চিমা বিশ্বের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক মানবধিকার সংগঠন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যারা মানবধিকার রক্ষার দাবিতে অত্যন্ত সোচ্ছার। তাদের কাজ মূলত পশ্চিমা বিশ্বের তাবেদারী করা, বিভিন্ন সংঘাতে তাদের মতবাদ তুলে ধরা। তবে তাদের নজরদারী বা খরবদারী আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেই বেশি। এর অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক পর-নির্ভরশীলতা, আত্মসমৃদ্ধির অভাব ও নিজেদের সামরিক, আর্থিক, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কিছু দেশে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করা হয়েছে। মনে করা হয় যে মানুষের জীবন তো একটাই। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতে একজন এ বিশ্বে আসে এবং তার ইচ্ছাতে চলে যায়। অতএব মানুষের বিচারে প্রাণ কেড়ে নেয়ার মতো চরম শাস্তি দেয়া ঠিক নয়।
মানবধিকার রক্ষাকারীদের বিশেষ দায়িত্ব হলো বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার বিরোধিতা করা। কিন্তু সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না যদি সেখানে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। আমাদের দেশে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে একটি অভিযান সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে হয়েছিল। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় অভিযান চালানোর সময় ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে এ ধরনের সন্দেহজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয় এরকম ঘটনা ঘটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা কিংবা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অসামজ্ঞসতা এধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা যখন দেখি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হয়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হলো তখন মানবধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তোলা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব দুঃখ পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে আরেকজন এশীয় জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন। তিনি বার্মার উ থান্ট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চলছিল। এই গণহত্যার কথা পাকিস্তানের বইতে পাওয়া যায়। বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্টের বর্ষসেরা বইগুলোগুলোর একটির নাম The Blood Telegram Nixon, Kissenger and Forgotten Genocide। বলাবাহুল্য পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার কথা এতে বলা হয়েছে। কিন্ত সে সময় জাতিসংঘের মহাসচিব এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেননি।
এরপরও আমরা পশ্চিমা বিশ্বের মানবধিকার নিয়ে এত উদ্বেগের গুরুত্ব দিতাম যদি দেখা যেত তারা এ ব্যাপারে আন্তরিক এবং কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে না। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিবাদী লেখিকা অরুন্ধতি রায়ের একটি উক্তি মনে পড়ে। নানা ছলনার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানো হয় এবং তারা দেশটি দখল করে। প্রধান অজুহাত ছিল যে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের কাছে গণবিধংসী অস্ত্রের পাহাড় রয়েছে। পরে দেখা গেল কিছুই নেই। তখন যে বক্তব্য আনা হলো, তা হলো ইরাকে গণতন্ত্র কায়েমের জন্য ওই দখল। যদিও ইতিহাসে অনেক নজির রয়েছে যে, বহু গণতন্ত্র হরণকারী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সাহায্য সহযোগিতা করেছে। আমরা নিজেরা ভুক্তভোগী।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক যখন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছিল যেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসে। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অরুন্ধতি রায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে একটি বাক্য ছিল Democracy is the free world whore। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত গোষ্ঠীর পতনের পর এখন ইউনিপোলার বিশ্ব। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপ্রতিরোধ্য একক ক্ষমতাধর।
তবে সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কিছুটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে চীন এবং ভারত। এটি শুভ লক্ষণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। অপরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যাকে তারা মুক্ত বিশ্ব বলে অভিহিত করে।
অরুন্ধতি রায় ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শুনতে খারাপ লাগলেও খুবই তাৎপর্য্য বহন করে বাক্যটি। মানবধিকার বক্তব্যটিও কি তথৈবচ? একটু আলোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাদ্দাম গ্রেপ্তার হলেন। তিনি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর আইন অনুযায়ী যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাকে বন্দী করে রাখার কথা। তাকে গ্রেপ্তার করার পর তার দাঁত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ। টেলিভিশনের পর্দায় বারবার দাঁত পরীক্ষা দেখানো হলো যেন সাদ্দাম একজন জোকার। তাকে সর্বোতভাবে হেয় করার জন্য এ দৃশ্য দেখানো হয়। এর পর বিচারের নামে প্রহসন করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো এবং ঈদের দিন ফাঁসি দেয়া হলো।
পশ্চিমাদেশগুলো কি তার মৃত্যু দণ্ডাদেশ রহিত করার ন্যূনতম প্রচেষ্টা দেখিয়েছিল? বলাবাহুল্য ইরাক সরকারতো তাদের বদৌলতে ক্ষমতাসীন হয়েছে। মানবধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি আদৌ কারো মাথায় এলোনা কেন?
লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির জন্য নিজের ব্যক্তিগত বিমান দিয়েছিলেন, সারকোজির ইলেকশনের জন্য বিশাল অংকের অর্থ সাহায্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন পশ্চিমা স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় তখন লিবিয়ার প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর একটি টু শব্দও করা হয়নি।
মার্কিন নাগরিকদের বড় ক্ষোভ এবং জ্বালা বিন লাদেনের উপর। তাদের অহমিকায় প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল বিন লাদেনের বাহিনী। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ কয়েক ঘণ্টার জন্য গৃহহীন হয়েছিলেন। কেননা লাদেন বাহিনীর আঘাত কোথায় না হানতে পারে এই আশঙ্কা। আতঙ্কিত হয়ে সে দেশের বিমান বাহিনী কয়েক ঘণ্টা আকাশে উড়ছিল। এই লাদেন অবশ্য তাদের সৃষ্টি। যাক সে কথা। চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলায় নিরীহ মানুষ মারা গেলে তখন মানবধিকার লঙ্ঘন হয় না!
তাই এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে পশ্চিমা বিশ্বের মানবধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার ভেতর কতটা আন্তরিক, আর কতটা শঠতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবধিকার সংগঠন হিউমেন রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের গণহত্যায় বিচারের পক্ষে না গিয়ে তারা অত্যন্ত নগ্নভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য মি. কাসাকা একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে পঠিত তার নিবন্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। ইতিপূর্বের ধারাবাহিকতায় দু’চারটি ছাড়া বাকি সব আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রভূ পশ্চিমাদের স্বার্থই সব সময় দেখে থাকে। মানবাধিকার সেখানে কোনো প্রসঙ্গ নয়।