স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র পেতে কি করার আছে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের? প্রায় অর্ধ্ব শতাব্দী আগে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি নারী লায়লা খালেদ। ১৯৬৯ সালে ইসরায়েলে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তির দাবিতে তিনি ও তার অনুসারীরা ২টি বিমান ছিনতাই করেন। এরপর লায়লা পৃথিবীর প্রথম নারী বিমান ছিনতাইকারীর হিসেবে পরিচিত হন। তারপর কেটে গেছে যুগের পর যুগ। আর ইসরায়েলিদের হাতে খুন ও আটক হয়েছেন লাখো ফিলিস্তিনি। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ‘প্লাস নাইন সেভেন টু ম্যাগাজিন’ এর পক্ষ থেকে পল সিমিট ‘লায়লা খালেদের’ সাক্ষাৎকার নেন। দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ তার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরছে-
পল সিমিট: আপনার বিমান ছিনতাই কি সন্ত্রাসবাদের পর্যায়ে পড়ে?
লায়লা খালেদ:‘না, এটি সন্ত্রাসবাদ নয়। আমি নির্যাতনের শিকার। মানুষ হিসাবে আমাদের যেকোন উপায়ে নির্যাতন প্রতিরোধ করার অধিকার রয়েছে’। তারপর তিনি মনে করিয়ে দিলেন যে ঐ ঘটনায় কেউ নিহত হয় নি।
পল সিমিট: কিন্তু একবার ভাবুন তো, ভয় পেয়ে বিমানের কেউ যদি হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যেত, তখন?
লায়লা: আমি খুব দুঃখিত হতাম। এবং তার পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতাম। আমি জানি সেখানে অনেক আতংক ছিল। কিন্তু একই সময়ে আমি তাদের স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম, তারা যাতে আতংকগ্রস্ত না হয়। বাস্তবে তারা সবাই প্রেসে পৌঁছে গিয়েছিল। কারওরই হার্ট এটাক বা এরকম কিছু হয় নি।
পল সিমিট: কেবল কেউ একজন তার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিল,তাই তো?
লায়লা: হ্যাঁ, তাই। তবে খুব কড়া নির্দেশ ছিল কাউকেই যেন কোনভাবে আঘাত করা না হয়। বিশেষ করে যাত্রীদের। আমাদের টার্গেট ওরা নয়। আমাদের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েল থেকে বন্দীদের মুক্ত করা। বিশেষ করে ওখানে থাকা নারীদের, যাদের অসংখ্যবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এবং আমাদের লক্ষ্য ছিল, আমাদের কমরেড, ভাই ও বোনদের দেখানো যে তোমরা একা নও, আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা যোদ্ধা। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা যখন গ্রেপ্তার হবে, তখন এ্ই মনোবল তাদের শক্তি যোগাবে। তারা যেন প্রসিকিউটরদের মুখোমুখি হতে পারে এবং একই সময়ে তারা যেন জানতে পারে, তাদেরকে একদিন না একদিন তাদের কমরেডরা মুক্ত করবেই।
কিন্তু যেখানে এখন পিএফএলএফ ছিনতাইকে আর সমর্থনযোগ্য মনে করে না, সেখানে লায়লা মনে করেন, সহিংসতাই আইনগত অস্ত্র। তিনি বলেন, ‘প্রতিরোধ কেবল সহিংসতার মধ্য দিয়েই করা সম্ভব, তা নয়। তবে সহিংসতাই হচ্ছে মূলধারা’।
পল সিমিট: আপনি বলতে চাইছেন প্রতিরোধের মূল উপায় সহিংসতা?
লায়লা: হ্যাঁ, এটাই প্রধান উপায়। প্রতিরোধ নানাধরণের হতে পারে, রাজনৈতিক প্রতিরোধ হতে পারে, রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। নারীরা যখন পোশাক এমব্রয়ডারী করেন, তখন সেটাও প্রতিরোধ হতে পারে।
পল সিমিট: বিডিএস নিয়ে আপনার মতামত কী?
লায়লা: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবশ্যই বিডিএস(বয়কট ডিভেস্টমেন্ট সেংশান) কার্যকরী। কিন্তু এটা ভূমি স্বাধীন করে না। যদি বিডিএস প্রত্যেক দেশেই থাকে এবং মানুষ প্রতিবাদ না করে, তবে কোনকিছুরই পরিবর্তন হবে না। বিডিএস আমাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সাহায্য করে, ইসরায়েল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সাহায্য করে এবং তারপর এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়। আমাদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে আরো বেশি মানুষ আমাদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় যারা অন্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে তাদেরকে বিডিএস সাহায্য করছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু যদি তারা অস্ত্র না ধরত, বিডিএস হয়তো রাজনৈতিকভাবেই তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারত, কিন্তু এটা তাদের কিংবা তাদের ভূখন্ডকে স্বাধীন করতে পারত না।
পল সিমিট: আপনার কি মনে হয় আপনি যুদ্ধে এভাবে জিততে পারবেন?
লায়লা: ভিয়েতনামে গরীবরাই আমেরিকানদের পরাজিত করেছিল।
পল সিমিট: কিন্তু সেটা ভিন্ন বিশ্ব ছিল, ড্রোন আবিষ্কার হওয়ার আগে।
লায়লা: যাই হোক না কেন! এখানে একটি মৌলিক সমীকরণ রয়েছে: যেখানেই নিপীড়ন, সেখানেই প্রতিরোধ। কেউ এর পরিবর্তন করতে পারে না। এটা মৌলিক, স্বাভাবিক। এটাই সত্য। যখন আপনাকে নির্যাতন করা হবে তখন আপনিও প্রতিরোধ করবেন।
পল সিমিট: কিন্তু যারা প্রতিরোধ করতে পছ্ন্দ করে না, সহিংসতার বিরুদ্ধে যারা, তাদেরকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
লায়লা: মাহমুদ আব্বাসের মত। তিনি কিছু্ই অর্জন করতে পারছেন না। তিনি শর্ত দেন আর ইসরায়েল তাদের অবজ্ঞা করে। এমনকি ইসরায়েল তাদের কোন আভাসই দিচ্ছে না তার অন্তত একটি শর্তও তারা মেনে নেবে। আমাকে বলতে দিন। ইয়াসির আরাফাত অসলো গিয়েছিলেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ইসরায়েল কী করেছে? তারা তাকে মুকাদ্দায় আটক করে রেখেছে এবং খুন করেছে।
পল সিমিট: আপনি সত্যিটা জানেন কী?
লায়লা: আপনার কি মনে আছে শ্যারন ও বুশ ওয়াশিংটনে তাদের বিখ্যাত মিটিংয়ে কী বলেছিল? শ্যারন বুশকে বলছিলেন তিনি ইয়াসির আরাফাতকে খুন করতে চান। বুশ বললেন, ‘তিনি খুবই বৃদ্ধ। আপনার করার দরকার নেই’। তখন শ্যারন বললেন, ‘সম্ভবত আমাদের সাহায্যই ঈশ্বরের প্রয়োজন’। প্রকৃতপক্ষে এরকম একটি মিটিং এবং এরকম সংলাপের উদ্দেশ্যই এক। এরিয়েল শ্যারনের বন্ধু ইসরায়েলি সাংবাদিক উরি ড্যান তার বই ‘এরিয়েল শ্যারন: এন ইনটিমেট পোর্ট্রেট’ বইতে ঐ মিটিংয়ের বিস্তারিত লিখেছেন।
পল সিমিট: হামাস সম্পর্কে বলুন, ইসরায়েল যাকে প্রধাণ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
লায়লা: হামাস বিশ্বাস করে ফিলিস্তিন কেবল মুসলিমদের। এটাই আমাদের, পিএফএলপির চিন্তার বিপরীত। কিন্তু এখন আলোচনা আদর্শ নিয়ে নয়, আলোচনা স্বাধীনতা নিয়ে। যারাই ইসরায়েলের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তারা, আমরা সবাই সমান কাতারের।
লায়লা তার জীবনীতে ফিলিস্তিন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমরা এসব কাটিয়ে উঠব এবং আরব, ইহুদী ও স্বাধীনতাকামীদের জন্য মানব স্বর্গে রূপান্তরিত করব’।লায়লা প্রত্যেকের জন্য একটি দেশ চান। তিনি বলেন, ‘আমরা আত্ম-সংকল্পের অধিকার চাই এবং ফিলিস্তিনের মাটিতে আমাদের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। দুইটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সমাধান আমি মানি না। ঐতিহাসিক লক্ষ্য একটিই, ফিলিস্তিনে একটিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া’।
পল সিমিটঃ ‘ফিলিস্তিন’ নাম নিয়ে আপনি কী বলবেন?
লায়লা: হ্যাঁ। আমরা এমনকি নামও পরিবর্তন করতে পারি, নাম কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে লোকজনকে এখানে থাকতে হবে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের স্বার্থে।
পল সিমিটঃ আপনার বইটি লেখা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। হয়তো জর্ডান সম্পর্কে আপনার মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। আপনার বই পড়ে মনে হয়েছে, ইসরায়েলের মত জর্ডানকেও আপনার বড় শত্রু মনে হয়।
লায়লা: না। আমাকে বলতে দিন। একটি নথিতে লিখা আছে, আমাদের শত্রু হল ইসরায়েল, ইহুদীবাদীদের আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদীরা। শুরু থেকেই আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে আমাদের শত্রু কারা। যাতে লোকজন মনে না করে যে তারা আজ আমাদের শত্রু, কাল আমাদের বন্ধু। না, আমি জর্ডানকে আমাদের শত্রু বলি নি।
পল সিমিট: আরবদের একত্রিত হওয়া দরকার।
লায়লা: আমরা আরব। আমাদের একই ইতিহাস, একই ভাষা রয়েছে। উপনিবেশ স্থাপনকারীদের দ্বারা আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি।
পল সিমিটঃ ক্রিশ্চানদের ব্যাপারে কী বলবেন?
লায়লা: আমি ধর্মের ব্যাপারে বলি নি। ক্রিশ্চানদেরও একই ইতিহাস আছে। আমরা সবাই উপনিবেশিক হয়ে আছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই।
পল সিমিটঃ সৌদি আরব সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?
লায়লা: সৌদি আরব তো আমেরিকানদের দ্বারা পরিচালিত।
পল সিমিটঃ ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। ফিলিস্তিন কি একা?
লায়লা: না। আমরা একা নই। আপনারা আমাদের সাথে আছেন।