ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে বন্দর ও কাস্টমস হাউসে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালনা এবং অটোমেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নসহ ৯ দফা সুপারিশ করেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি বলছে, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসের বিভিন্ন কার্যক্রম এখনও কাগুজে পদ্ধতিতে থাকায় বিভিন্ন স্তরে অবৈধ অর্থ লেনদেন অব্যাহত রয়েছে। অনলাইন সুবিধা চালুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসে দুর্নীতি কমানো সম্ভব। শুল্কায়ন ও পণ্য ছাড় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইন সুবিধার আওতায় আনা হলে দুর্নীতি অনেকাংশে বন্ধ হবে।
এ ছাড়া শুল্কায়ন ও পণ্য ছাড় প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের চিত্র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ ছাড়া বন্দরে অটোমেশনে চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পূর্বেই প্রকল্পের মূল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া টিআইবির প্রতিবেদনে শুল্কায়নে বিভিন্ন ধাপে সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা, কায়িক পরীক্ষণে ১০০ থেকে চার হাজার টাকা, কাস্টমস হাউসে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে দৈনিক ন্যূনতম ৪৭ লাখ পাঁচ টাকা এবং পণ্য ছাড়ে দৈনিক ন্যূনতম ১৭ লাখ দুই হাজার টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে আদায়ের অভিযোগের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এসব সুপারিশ উত্থাপন করে। ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় অটোমেশন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান এবং উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই-খোদা ও জুলিয়েট রোজেটি। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসের ওপর পরিচালিত গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অটোমেশন পদ্ধতির আংশিক বাস্তবায়নের ফলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বন্দরে অটোমেশন বা সিটিএমএস বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমানে ইন্টারনেট বা মোবাইলের মাধ্যমে টার্মিনালের বিভিন্ন ইয়ার্ডে কন্টেইনারের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে।
ওয়েব নির্ভর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সংস্করণের ফলে যে কোনো স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট ফরমে তথ্য দেয়ার সুবিধা, অনলাইনে ইমপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্টো (আইজিএম) দাখিলের পর বিল অব এন্ট্রি ফরম পূরণ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেজিস্ট্রেশন নম্বর (সি নাম্বার) তৈরি করা, অনলাইনে বিল অব এন্ট্রি ফরম পূরণ করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যের এইচএস কোড অনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণ, নির্ধারিত হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক পরিশোধের ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্য সহজেই জানা সম্ভব হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উভয় প্রতিষ্ঠানে অটোমেশন আংশিক বাস্তবায়ন হলেও প্রায়োগিক সাফল্য নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারী ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের মধ্যে অসন্তোষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
অটোমেশন বাস্তবায়নের কিছু ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের কার্যকর সফলতা অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে কাস্টমস হাউসে অটোমেশনের মাধ্যমে কাগজবিহীন অফিস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনও প্রতিটি ধাপে ম্যানুয়াল স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কমার্শিয়াল পণ্যের শুল্কমূল্য পরিশোধ চালু না হওয়া, কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সহায়তাকারী হিসেবে অবৈধভাবে ৬০-৭০ ব্যক্তির নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ, বন্দরে সংশ্লিষ্ট সব ব্যবহারকারীর আগ্রহ ও আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, ইয়ার্ডে কন্টেইনার স্ট্রিপিং বন্ধ করা, বন্দরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে কন্টেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিটিএমএস) প্রয়োজনীয় মডিউলগুলো তাদের সরবরাহ না করা বা ব্যবহারের নির্দেশ না দেয়া ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বার্থান্বেষী কিছু মহলের যোগসাজশ ও কারসাজির কারণে একদিকে যেমন অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে না, অন্যদিকে তারা আর্থিকভাবে বিশেষ লাভবানও হচ্ছেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে। অবৈধ লেনদেনের সুযোগকে অটোমেশন বাস্তবায়নে অনীহা ও প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস হাউসে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।
টিআইবির সুপারিশগুলো হচ্ছে— বন্দরে সিটিএমএসের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সব মডিউল প্রস্তুত ও ব্যবহার, বন্দরের অভ্যন্তরে কন্টেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ করা, স্বাধীন, নিরপেক্ষ তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে বন্দর ও কাস্টমস হাউসের কর্মদক্ষতা ও অটোমেশনের কার্যকরতা পরিমাপে ‘পারফরমেন্স ইভ্যালুয়েশন’ করা, কাস্টমস হাউস ও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নিয়ম বহর্ভূিত অর্থ আদায় সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া, কাস্টমস হাউস ও বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক আচরণ বিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং বছরে একবার সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব ও বিবরণ প্রকাশ করা।