বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যে কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না, তা আবারও প্রমাণিত হলো সম্প্রতি সমুদ্রসীমা নিয়ে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে দেওয়া রায়ের বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায়। এই রায়কে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বিরাট বিজয় বলে অভিহিত করলেও বিএনপি বলেছে, ব্যাপক পরাজয়।
বিএনপির নেতারা বলতে চাইছেন যে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার পেলেও বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথায়, কীভাবে দেওয়া হলো, রায়ের আগ পর্যন্ত বিএনপির নেতারা সেই ছয় হাজার ১৩৫ কিলোমিটার উদ্ধারে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা নেই।অবশ্য এখন ভারতের গনমাধ্যম মারফত জানা যাচ্ছে ভারতের পাওয়া অংশে বাংলাদেশের বর্তমান মজুদের দ্বিগুন গ্যাস মজুদ আছে,যাতে কিনা অনেকে এটাকে সাজানো বলছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের রাজনীতি ক্রমেই বিকারগ্রস্ততার দিকে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারি দলের নেতারাও কম যান না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে সমুদ্র বিজয় হতো কি না সন্দেহ। এ পর্যন্ত না হয় মানা গেল। কিন্তু তিনি যখন বিএনপির নেতাদের সমালোচনার জবাবে তাঁদের দক্ষিণ তালপট্টি খুঁজে দেখার পরামর্শ দেন, তখনই খটকা লাগে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে ১৯৮০ সালের পর বাংলাদেশের কোনো মানচিত্রে দক্ষিণ তালপট্টির অস্তিত্ব নেই। ১৯৮০ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। মানলাম, তাঁরা মানচিত্রে দক্ষিণ তালপট্টি না রেখে কবিরাহ গুনাহ করেছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই গুনাহকে লাঘব করার কোনো উদ্যোগ নিল না কেন?
দক্ষিণ তালপট্টির অস্তিত্ব নেই—আদালতে বাংলাদেশ এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল। আর ভারতের চেষ্টা ছিল দক্ষিণ তালপট্টি আছে, সেটা দেখানো। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ভারতের প্রয়াস সফল হলে বঙ্গোপসাগরে তাদের সীমানা আরও বাড়ত। দ্বীপের চারপাশের কিছু এলাকারও মালিকানা পেত তারা। ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে দক্ষিণ তালপট্টি বা অন্য কোনো দ্বীপ জেগে উঠলে তার মালিকানা নিয়েও বিরোধ দেখা দিতে পারে। তাই দক্ষিণ তালপট্টি নেই ভেবে ক্ষমতাসীনদের আহ্লাদিত হওয়ার কারণ নেই।
২.
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘রাজনীতির একটি পক্ষ এখনো স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। মনে-প্রাণে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেতে চায়। যারা জয় বাংলা বলতে লজ্জা পায়, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়, তারা পাকিস্তানের এজেন্ট। তাদের সেখানেই চলে যাওয়া উচিত। (সমকাল, ১২ জুলাই ২০১৪)।
কারও নাম উল্লেখ না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিএনপিকে উদ্দেশ করেই তিনি এসব কথা বলেছেন। কোনো দলের নীতি ও আদর্শের সমালোচনা করা আর সেই দলকে পাকিস্তানের বা অন্য কোনো দেশের এজেন্ট বানানো এক কথা নয়। এখন বিএনপি বা তার সহযোগী কোনো দল ক্ষমতায় নেই। সজীব ওয়াজেদ যে দলের সদস্যপদ নিয়েছেন, সেই আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আছে মহাপ্রতাপ নিয়ে। অতএব, যাঁরা বিদেশি এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের ও জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বটা সরকারেরই।
স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও যারা মনে-প্রাণে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেতে চায়, তাদের ঠিকানা তো হওয়া উচিত জেলখানা। কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত এই অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে বলে জানা নেই।
সজীব ওয়াজেদ জিন্দাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছেন, এটি যেহেতু উর্দু শব্দ (আসলে এটি ফারসি শব্দ), সেহেতু বাংলাদেশে চলতে পারে না এবং যারা জিন্দাবাদ বলবে, তাদের পাকিস্তানেই চলে যাওয়া উচিত। তাঁর এই যুক্তি মেনে নিলে বাংলা ভাষাকেই নতুন করে লিখতে হবে। বহু বিদেশি শব্দের সমাহারে হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার ভিত তৈরি হয়েছে। উর্দু শব্দ বলে যদি জিন্দাবাদ পরিত্যাজ্য হয়, তাহলে ‘আওয়ামী’ শব্দটি কেন হবে না? এটিও উর্দু শব্দ। ‘আওয়াম’ শব্দের অর্থ গণ বা জনগণ। সেই ‘আওয়াম’ থেকেই আওয়ামী লীগ নামের দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৯ সালে (প্রথমে নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ)। নামের অপরাংশ ‘লীগ’ও নেওয়া হয়েছে ইংরেজি থেকে। আওয়ামী লীগের পুরো নামে কোথাও ‘বাংলা’ নেই বলে কি আমরা এটিকে বিদেশি দল হিসেবে চিহ্নিত করব?
যেকোনো দলকে বিচার করতে হবে কাজ দিয়ে। কোন দলের নাম উর্দুতে হলো আর কোন দল হিন্দি স্লোগান ব্যবহার করল, সেসব দিয়ে নয়। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ ত্যাগ করেছে, এ কথাও পুরো সত্য নয়। সংবিধানে জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ শব্দটি যেমন আওয়ামী লীগ সাদরে গ্রহণ করেছে, তেমনি জিন্দাবাদও, তবে বাংলা অনুবাদ করে। বিএনপি বা অন্য আরও অনেক দল যেমন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে, তেমনি আওয়ামী লীগ এটিকে বাংলা তরজমা করে নিয়েছে: ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’। আওয়ামী লীগের সব নেতা জয় বাংলার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ বলে বক্তব্য শেষ করেন।
দোষ শব্দ বা ভাষার নয়। দোষ হলো আমরা সেই শব্দ বা ভাষাকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি। ইনকিলাব একসময় উপমহাদেশে বিপ্লবীদের স্লোগান ছিল। বাংলাদেশের একজন রাজাকার নেতা সেই নাম ব্যবহার করে পত্রিকা বের করে মানুষের শুভবোধ ও চিন্তার বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়েছেন বলে ইনকিলাব শব্দটি বাতিল হয়ে যেতে পারে না। তেমনি জিন্দাবাদও।
৩.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, পঞ্চাশের দশক থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু জয় বাংলা স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের এক কর্মিসভায়। এরপর এটি তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি প্রধান রণধ্বনিতে রূপান্তরিত হলেও সব মুক্তিযোদ্ধা এই স্লোগান দেননি। অনেকে সমাজ বিপ্লবের পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন। তাহলে জয় বাংলা স্লোগান না দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও কি এখন পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে হবে? একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে জয় বাংলা বা জিন্দাবাদ নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। বিতর্ক হয়েছে স্বাধীনতার পরে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ও তার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জয় বাংলা ছিল বাঙালির রাজনৈতিক স্লোগান। নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিপীড়িতের, সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে অধিকারবঞ্চিতদের স্লোগান। কিন্তু স্বাধীনতার পর এই স্লোগানের চরিত্র পুরোপুরি বদলে যায়। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে, এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে এই স্লোগান কাজে লাগান। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছিলেন, তাঁদের একাংশ যেমন স্বাধীনতার পর এই স্লোগানকে বর্জন করে, তেমনি যাঁরা সে সময় জয় বাংলা স্লোগান দিতেন না, আওয়ামী লীগে এসে এখন সেই স্লোগান রপ্ত করেছেন। বর্তমান মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য আছেন, যাঁরা এখনো জয় বাংলা বলেন না, তাই বলে কি তাঁরা মনে-প্রাণে পাকিস্তানি হয়ে গেছেন? জয় বাংলা স্লোগানের উদ্যোক্তা ছাত্রলীগ স্বাধীনতার পর বিভক্ত হয়ে পড়লে একাংশ আর এই স্লোগান ব্যবহার করে না। আজও না। তাদেরও কি পাকিস্তানে চলে যেতে হবে?
সত্য যে জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রণধ্বনি স্লোগান ছিল। আবার এও অসত্য নয় যে, এই স্লোগান দিয়ে অনেক অপকর্মও সাধিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের ক্ষমতাসীন অংশটি এই জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই ডাকসুর ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করেছিল। ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে সাত খুনের হোতারাও এই স্লোগান দিয়েছিল। পরবর্তীকালে এই স্লোগান অনেক দুষ্কৃতকারীর কণ্ঠেও শোনা গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, বর্তমানে সারা দেশে ছাত্রলীগের নামে যে খুনোখুনি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে, তা করছে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশকারীরা। তারা কেউই আগের জিন্দাবাদ বা ইসলামি শাসন কায়েমের স্লোগান দিচ্ছে না। জয় বাংলা বলেই এসব করছে। যে স্লোগান একাত্তরের প্রধান (একমাত্র নয়) রণধ্বনি ছিল, সেটি এখন একটি রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছে। তাই সবাইকে জোর করে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ানোর চেষ্টা ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলেই মনে করি।
আর জিন্দাবাদ স্লোগান যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরাও এটিকে অন্যায্যভাবে জয় বাংলার বিপরীতে ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে মুসলমানি জোশ আবিষ্কার করছেন। কিন্তু অভিধান অনুযায়ী জিন্দা মানে বেঁচে থাকা, জয়ী হওয়া। সেদিক থেকে জিন্দাবাদ ও জয় বাংলার মধ্যে বড় ফারাক দেখি না। ফারাকটি করেছে স্বার্থবাদী ও সংকীর্ণ রাজনীতি। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত কোনো দলই এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমনকি নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও নন। দেখা যাক তারা ভবিষ্যতে কি করেন।