স্বাধীনতার ৬৭ বছর পর, পাকিস্তানিরা এখনও রাস্তায় রাস্তায় ভজন গীত গায়: ‘পাকিস্তান কা মাতলাব ক্যায়া(পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী)? এর উত্তর, অবশ্যই ইসলাম। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামের জন্য’।
যদিও, পাকিস্তান ইসলাম না কি ভিন্ন কিছুর জন্য সৃষ্টি হয়েছে সে দ্বন্দ্ব এখনও নিরসন হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও হবার কোন লক্ষণ নেই। তবে যাইহোক না কেন, ধর্মীয় দলগুলো মূলত এই স্লোগানকে ব্যবহার করে দেশটির ইসলামী পরিচয়কে শক্তিশালী করার জন্য। কারণ কাগজে-কলমে, পাকিস্তান একটি ইসলামিক রিপাবলিক এবং ধর্মীয় দলগুলো স্লোগানটি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত করতে চান যে অদূর ভবিষ্যতেও দেশটি এই পরিচয় বহন করবে।
এবং তারা তাদের এই লক্ষ্য অর্জনে বেশ সফল হয়েছেও বলা যায়, কারণ ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়া থেকে পৃথক হবার পর, তারা ধর্মীয়ভাবে যে অবস্থানে ছিল, বর্তমানে তার চেয়ে আরো বেশি রক্ষণশীল ও গোঁড়া হয়েছে।
জরিপ: অধিকাংশ পাকিস্তানিই চরমপন্থা ও জঙ্গীবাদকে ভয় পায় এবং তালেবানকে অপছন্দ করে।
১৯৮০ সালে আফগান যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় দলগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৮৯ সালের পর, সোভিয়েত যখন আফগানিস্তানকে ছেড়ে যায়, তখন ধর্মীয় দলগুলো সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে তারা আফগান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে।
মূলত, দেশটির সিভিল ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদেশ নীতির উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য এই ধর্মীয় দলগুলোকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ফলে ধর্মীয় দলগুলো তাদের কাছ থেকেও প্রচুর সমর্থন পায়।
তখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহৎ পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত হয়েছিল যেখানে পুরো মুসলিম বিশ্ব থেকে জঙ্গী দলগুলোকে একত্রে নিয়ে আসা হয়েছিল। দেশটিতে সব ধরণের পরীক্ষণের জন্য প্রাথমিকভাবে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও আরব জোটগুলো। এই অনুশীলন নিয়ে এসেছিল তালেবান জঙ্গীদেরকেও। তালেবান জঙ্গীরা প্রাথমিক নির্দেশনা পেয়েছিল পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে, কিন্তু শীঘ্রই তাদেরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল তালেবানরা।
ইন্ডিয়ার সাথে সম্ভাব্য সংঘাতের সময় আফগানিস্তানের জঙ্গীদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের। এই লক্ষ্য কখনও অর্জন হয় নি। বরং জঙ্গীরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতোমধ্যেই তারা পাকিস্তানের ৬ হাজার যোদ্ধাসহ ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এবং ডজন ডজন অনুষ্ঠানে তারা এটাই প্রমাণ করেছে যে, তাদের যখন ইচ্ছা তখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যেকোন সময় তারা আঘাত হানতে পারে।
দেশটির আদিবাসী অঞ্চলে তালেবানদের বিরুদ্ধে মেজর অপারেশন চালাতে এটাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাধ্য করেছে। আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানদের গোপন আস্তানা গুটিয়ে নিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে সেনাবাহিনী। যদিও তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছে কিনা কিংবা আরো বেশি রক্ত ঝরাতে তাদের গোপন আস্তানা থেকে ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত না।
পাকিস্তানের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর অ্যাকশান নেয়ার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের:
কিন্তু পাকিস্তানের পরিচয় সংকটের প্রকৃত কারণ তালেবানরা নয়। তারা হচ্ছে শুধুমাত্র লক্ষণ।
প্রকৃত কারণ হচ্ছে ঐ স্লোগান (পাকিস্তান কা মাতলাব ক্যায়া?), যা পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় ভজন হিসেবে উচ্চারিত হয়। এই স্লোগানগুলো উল্লাসভরে উচ্চারণ করা দেশটির ধর্মীয় পরিচয় জোরদার করার প্রচেষ্টাকে মোটেই বুঝায় না, বরং দেশটির অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ তৈরি করে।
সাধারণ জনগণের উপর ধর্মীয় দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাই পাকিস্তানের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করে রেখেছে। ধর্মীয় দলগুলোর যুক্তি হল, পাকিস্তান কী কারণে সৃষ্টি হয়েছে প্রথমে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের মতে, দেশটির উচিত এই মূল ইস্যুটি পুনরায় সমাধান করার পরেই অন্য ইস্যুতে মনোযোগ দেওয়া। যেকোন মূল্যে আগে মূল ইস্যুটি সমাধান করতে হবে।
ব্যাপারটা এমন যেন পরিবারের জন্য একটি গাড়ি কেনা হল এবং গাড়িটি ততক্ষণ পর্যন্ত চালানো হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি কী কারণে কেনা হয়েছে তার মীমাংসা করা না হয়। কারণগুলো এরকম হতে পারে: পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যদের কাজে নিয়ে যাওয়া? শিশুদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া? আমন্ত্রিত বন্ধুদের জন্য কেনাকাটা করা?
উত্তরটা একেবারেই স্পষ্ট। গাড়িটি এই সকল সেবাই দিতে পারে। তবে গাড়ির মালিক, এর জন্য অবশ্যই প্রথমে গাড়িটি চালাতে হবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো কাউকেই গাড়িটি চালাবার অনুমতি দিচ্ছে না, যতক্ষণ না বিষয়টি মীমাংসিত হচ্ছে- পাকিস্তান কা মাতলাব ক্যায়া?
অন্যান্য অধিকাংশ দেশের মতই, পাকিস্তানেও ধর্মীয় অধিকার, উদারপন্থী, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষরা রয়েছে যারা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করতে চায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, কোন ব্যক্তি কিংবা দলই চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না। কোন ধর্মীয় দল শাসিত সরকার আপনার থাকতে পারে, যেটা এবছর ইন্ডিয়ায় ঘটেছে। এই ক্ষমতা উদারপন্থী, সমাজতান্ত্রিক দল কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ দলের কাছেও যেতে পারে। লোকজন যাকে ভোট দেবে, সেই ক্ষমতায় থাকবে।
ক্ষমতায় থাকলে যেকোন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার অধিকার সব দলেরই আছে। তেমনি অন্যদেরও এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করার অধিকার আছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল থাকার কারণও এটাই।
পাকিস্তানের আদর্শ: একটি চমৎকার দুরভিসন্ধির ইতিহাস
গণতন্ত্রে, রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল, তা জিজ্ঞেস করাই ভুল।
উদ্দেশ্য স্পষ্ট। একটি রাষ্ট্র তৈরি হয় যাতে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে কোন দলকে বাস করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে, সেটি ছোট কিংবা বড় দল যাই হোক না কেন। রাষ্ট্র আগে এই লক্ষ্যটি অর্জন করবে, তারপর জনসংখ্যার জন্য স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে যাতে তারা শান্তি-সমৃদ্ধিতে বাস করতে পারে।
এই রাষ্ট্রের জনগণের ভোট দেয়ার অধিকার আছে, তারা যদি মনে করে কেউ তাদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারবে তাকে ক্ষমতায় আনার অধিকারও তাদের আছে। যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা দল তাদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে ঐ দলকে বাইরে বেরোবার দরজা দেখিয়ে দিতে পারে এবং তা উচিতও। তবে আগে নয়, ঠিক যেটা পাকিস্তানে প্রায় ঘটে। যারা জনগণের সেবা করতে চায়, তাদের নীতি-আদর্শের উদ্দেশ্য কী এবং কিভাবে তারা লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তা দেখানো তাদের দায়িত্ব।
তাই, ঐ দলগুলোকে যে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা উচিত তা হল, তারা যে নীতিটি বাস্তবায়ন করতে চায় তার উদ্দেশ্য কী।
কিন্তু এই প্রশ্ন নয় যে, পাকিস্তান কা মাতলাব ক্যায়া?