দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আজকের চরম শত্রু হামাস প্রতিষ্ঠায় সরাসরি সহায়তা দিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী। এর পেছনে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। সে সময় স্বাধীন-স্বার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছিল ধর্মনিরপেক্ষ প্যালেস্টাইন লিবারেশন মুভমেন্ট।
ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দারা চাইছিল, প্যালেস্টাইন লিবারেশন মুভমেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি ধর্মীয় গ্রুপ তৈরী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠনের প্রচেষ্টাকে দমিয়ে দেওয়া। ইসরায়েলের সেই প্রচেষ্টার সফলতা হিসেবে আজ ফিলিস্তিন প্রশাসনিকভাবেই দুইভাবে বিভক্ত। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করছে ফাতাহ আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস। এইভাবে দ্বিধা-বিভক্ত ফিলিস্তিনিরা এখন ইসরায়েলের সবচেয়ে সহজতর শিকার।
হামাসের আন্দোলন সম্পর্কে হামজা নামের একজন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামকারীর বক্তব্য হচ্ছে, দ্বিতীয় ইন্তিফাদা আন্দোলন চলাকালে হামাস মুক্তি-সংগ্রামের পথ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করতে শুরু করে যে, কেবল আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তারা আলোচনার টেবিল থেকে সরে এসে আত্মঘাতী বোমা হামলা শুরু করে। হামাস ইসরায়েলীদেরকে যে ব্যাথা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিল, তার বেদনা ভুগতে হচ্ছে আমাদেরকেই। হামজার এই বক্তব্যটি সংগ্রহ করেন ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে গবেষণা গ্রন্থের লেখক এভি আইজ্যাকশ্রফ।
হামাসের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি পুরোপুরিই নির্ভর করে বৈদেশিক সহায়তার ওপর। ফিলিস্তিনের জনগণের বিশাল একটি অংশের কাছে ঘৃণার পাত্র এই সংগঠনটি। বলা হয়, ফিলিস্তিনীরা ইসরায়েলের সেনাদের যতটানা ভয় পায় তার চেয়েও বেশি হামাসের সদস্যদের নিয়ে শঙ্কিত থাকে।
কথিত ইসলামী বিপ্লবী সংগঠন ‘হামাস’ গাজা নিয়ন্ত্রণ করলেও ওই অঞ্চলটির অর্থনীতি থেকে শুরু করে নিত্যদিনকার জীবন-যাপন পুরোপুরি ইসরায়েল সরকারের হাতের মুঠোয়।
বিদেশী সহায়তা ছাড়া পঙ্গু হামাস
মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিন সংস্করণ হিসেবে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এরপর থেকেই মুসলিম বিশ্বের ধনকুবেরদের আর্থিক সহায়তার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়ে আসছে হামাস। সৌদি আরব, কাতার, ইরানের মতো দেশগুলো নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ সহায়তা করেছে এই সংগঠনটিকে। ২০০০ সালের শুরুতেই হামাসকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা দিতে শুরু করে সৌদি আরব।
সৌদি আরবের আল তাকওয়া ব্যাংকের মাধ্যমেই হামাস তাদের আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করত। আল কায়েদার আর্থিক লেনদেনও এই ব্যাংকটির মাধ্যমেই হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। হামাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থায়নকারী দেশটি হলো ইরান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামাসকে অর্থ সহায়তা দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে সৌদি আরব। এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে হামাসের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে ইরান।
হামাস প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলের ভূমিকা
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই একই ভূখন্ডের ওপর মালিকানা দাবি করতে থাকে ইসরায়েল সরকার ও ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলতে থাকে ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন। সত্তরের দশকে গাজার মুসলমানদের বিষয়ে ভাবতে শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ওই সময়গুলোতে গাজার মুসলমানরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইত্যাদি বিষয়ে ভাবার চাইতে কুরান শরীফ পাঠেই বেশি মনযোগী ছিল।
সে সময় ইসরায়েল সরকার গাজায় মুজামা আল ইসলামিয়া নামের একটি সংস্থাকে দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই সংস্থাটির প্রধান ছিলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন। সে সময় থেকেই শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা দিতে শুরু করে ইসরায়েল। এই স্বীকৃতির সুযোগে গাজায় স্কুল, লাইব্রেরী, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে শেখ আহমেদ ইয়াসিনই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের হামাস। হামাসের নেতা হিসেবে শেখ আহমেদ ইয়াসিন ব্যাপক সমাদৃত। তবে এই ধর্মীয় নেতার মৃত্যু হয় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হাতেই।
এই কারণেই ইসরায়েল-হামাসের সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান সম্পর্কের সাথে তুলনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে আফগানিস্তানে তালিবান তৈরীতে সহায়তা করেছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সেই তালিবানরাই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। তেমনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে হামাস প্রতিষ্ঠা করে, বর্তমানে সেই হামাসের পক্ষ থেকেই শত্রুতার শিকার হচ্ছে ইসরায়েল।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার অর্থনীতি ইসরায়েলের হাতে
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রাখলেও ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি হাতের মুঠোয় রেখেছে ইসরায়েল। এমনকি গাজায় কি ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে, কি হবে না তাও নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
হামাস গাজা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকেই ওই এলাকায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয় মিশর ও ইসরায়েল। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নিজেদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতাসীন বলে দাবি করলেও এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেনি হামাস। ফলে, গাজাবাসীদের চলাফেরা, কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকার ফিলিস্তিনিরা প্রায় মৃত জীবনযাপন করছেন। গাজার ১৭ লক্ষ মানুষের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ হামাসকে সমর্থন করে। দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বসবাসের পর হামাসের সমর্থক-বিরোধী নির্বিশেষে গাজাবাসীরা নিজেদের মুক্তি চাইছেন।