দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ অনুবাদ: সায়েদ আসিফ মাহমুদ একজন ঢাকাভিত্তিক ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার এবং পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। বাংলাদেশের সিগারেট শিল্প নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ও সিগারেট কারখানাগুলোর অন্তরালের গল্প নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা পত্রিকা টাইম। প্রথম বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য টাইম পত্রিকার প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হলো:
প্রায় এক বছর বাংলাদেশের সিগারেট কারখানাগুলোর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন সায়েদ আসিফ মাহমুদ। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া জুড়ে প্যাকেটজাত সিগারেটের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়, সস্তা, নিম্নমানের তামাক মেশানো, হাতে রোল করা সিগারেট কারা তৈরি করে তা ডকুমেন্ট করার জন্য তার এই অভিযান। এর পর তিনি থেমে যান। টাইম পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময়ই একটা দ্বন্দ্বে থাকতাম যে আমিই সেই সঠিক ব্যক্তি কিনা যে অন্যদের গল্পগুলো বলবে। কেন আমি এটা করছি? আমার জন্য নাকি তাদের জন্য’?
২০০৮ সালের শেষের দিকে, বিজনেস স্কুল থেকে তৃতীয় বর্ষ শেষ করার সময় ঢাকায় পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে পড়ানো শুরু করেন তিনি। একটি গল্পের সন্ধানে, তিনি তার নিজশহর রংপুরের আশেপাশের কারখানাগুলোতে নিয়মিত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। রংপুরকে বেছে নেবার কারণ উত্তরবঙ্গে তামাক চাষ অনেক বেশি হয়। তবে, ২৮ বছর বয়সী আসিফ, কখনোই তার আলোকচিত্র নিয়ে এত রোমাঞ্চিত হন নি, এত গভীরে যাওয়ার জন্য আঁকাআঁকি করেননি এবং ব্যক্তিগত প্রজেক্টকে প্রাধান্য দেওয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন। যাহোক, শ্রমিকরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করল কেন তিনি ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন, তারপর থেকেই তিনি আবার তার কাজে ফিরে এলেন। ২০১০ সালে সেপ্টেম্বর যখন তিনি তার পুরোনো গল্পে ফিরে এলেন তখন তিনি অতীতের মতই তার গল্পটি আক্ষরিকতার চাইতে পরামর্শের ভিত্তিতে নির্মাণ করা শুরু করলেন।
সিগারেট কারখানার বিপদ সম্পর্কে অসংখ্য প্রতিবেদনে বর্ণণা করা হয়েছে যে, বিষাক্ত রাষায়নিক এবং তামাকের ধূলা থেকে বাঁচার জন্য কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না শ্রমিকরা। প্রতিবেদনগুলোতে বারবার তুলে ধরা হয়, সিগারেট টানার সাথে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এমফাসেমা ও সুনিশ্চিত ক্যান্সার জড়িত।
২০০৯ সালে গ্লোবাল অ্যাডাল্প টোবাকো সার্ভে দেখে যে, ১৫ বছর কিংবা তদোর্ধ্ব বাংলাদেশীদের মধ্যে ২৩ শতাংশ মানুষ তামাকজাতীয় দ্রব্য দিয়ে ধূমপান করে। প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষের অর্ধেকই সিগারেট খায়, দিনে সাতটা করে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে এই হার ১৩.৫ শতাংশ, যেখানে অধিকাংশ কারখানাই অবস্থিত। শহরাঞ্চলে এই হার ৪.৭ শতাংশ।
আসিফ তার অধিকাংশ সময় উত্তরাঞ্চলে কাটালেও বৃক্ষনিধনের প্রভাব দেখেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন দক্ষিণেও(যেখানে গাছ কেটে সেগুলো তামাক পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়)। যেসব শ্রমিকরা তামাক পাতা তোলে এবং রোদে শুকায়, তাদের ছবি তুলেছেন তিনি। কারখানার মালিকদের কাছে বিক্রি করার আগে যে মাটির ঘরটিতে তামাক পাতা পোড়ান হয় তার ছবিও নথিবন্দী করেছেন। যেখানে পাতাগুলোকে চূর্ণ চূর্ণ করা হয় যাতে তা সহজে রোল করা যায় এবং হাত দিয়ে বাঁধা যায়, সেই জনাকীর্ণ, দুর্বল ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাও দেখেছেন তিনি।
আসিফ বলেন, ‘কারখানার বাইরে তারা বলে, আমাদের এখানে কোন শিশু শ্রমিক নেই। কিন্তু ভেতরে সম্পূ্র্ণই ভিন্ন চিত্র’। বাড়িতে সাধারণত শিশুরাই কাগজগুলো রোল করে এবং তাতে তামাক ভরে পাঠিয়ে দেয় কারখানাগুলোতে, তারপর রাতে এগুলো শক্ত করে বাঁধে এবং পরের দিন জমা দেয়।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এখানকার শ্রমিকরা এবং তাদের এলাকায় অন্যান্য কাজের সুযোগও নেই।
২০১২ সালে জুলাই এ, কুষ্টিয়ায় আকিজ সিগারেট কারখানার বাইরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে, নিরাপত্তী রক্ষীরা ভিড়ের মধ্যে গুলি চালালে ৩ শ্রমিক নিহত হয়। এরপরেই, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠান। কিন্তু মৃত্যু এই ধরনের পরিস্থিতির খুব কমই পরিবর্তন করতে পারে, যেহেতু কিছু কিছু অঞ্চলে এই কর্মক্ষেত্রগুলোই বেশিভাগ শ্রমিকদের উপার্জনের জায়গা এবং সিগারেটের ব্যবহার ব্যাপক। আসিফ ব্যাখ্যা করেন, ‘আপনি কারখানাগুলো বন্ধ করতে পারবেন না। ওরা স্রেফ মারা যাবে’।
আসিফ ‘এনপিপিএ-অনারড প্রজেক্টের’ কথা বিবেচনা করছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘টোবাকো টেল’। প্রজেক্টের কাজ ইতোমধ্যেই অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে এবং আসিফ প্রজেক্টিকে উৎপাদন থেকে সরিয়ে ভোগের দিক থেকে বিবেচনা করতে চাচ্ছে। তাই তিনি দেখাতে চেয়েছেন, কিভাবে বিজ্ঞাপন ও মুভি (‘যেখানে নায়করা ধূমপান করে)’- তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানের দিকে আকৃষ্ট করে। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্ম মুভির হিরোদের দেখে ধূমপানের দিকে আকৃষ্ট হয়।
তার আলোকচিত্রের বিষয়বস্তুই তাকে মর্যাদার আসন দান করে। কারণ এই আলোকচিত্রগুলোই হয়ত সিগারেট কারখানার শ্রমিকদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য বা ভাল বেতন পরিশোধের জন্য কারখানার মালিকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই চিত্র দেখা যায় না।
আসিফ বলেন, ‘আমি মনে করি না আলোকচিত্র সবকিছু বদলাতে পারে। আমি ঐ ধরণের স্বপ্নীল মানুষ নই’। কিন্তু তিনি স্বীকার করেন, ‘তার আলোকচিত্রগুলো জনগণের সচেতনতায় প্রভাব ফেলতে পারে’।