বারবার রিমান্ড থেকে বাঁচতে আইনের ফাঁক গলে নিরাপদে থাকার কৌশল নিয়েছিলেন মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ। স্বীকারোক্তি দিতে এসে বেঁকে বসেছিলেন তিনি। কিন্তু আদালত সে সুযোগ দেননি। ফের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
বৃহস্পতিবার তিন দিনের রিমান্ড শেষে ওই হত্যা মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য দুই আসামি এসআই জাহিদ ও পুলিশের সোর্স নাসিমকে আদালতে হাজির করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মন।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্তর কাছে সোর্স নাসিম স্বীকারোক্তি দিলেও বেঁকে বসেন এসআই জাহিদ।
সে কারণে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাহিদকে ফের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তীর আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আইন অনুযায়ী, কোনো আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার জন্য আদালতে এসে মত পাল্টালেও তাকে আর রিমান্ডে নেয়া যায় না। ঠিক এই সুযোগটিই নিতে চেয়েছিলেন এসআই জাহিদ।
আদালতের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে হাজির করা হয় এসআই জাহিদকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করলেও তিনি স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হননি। অথচ তিনি স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ার কারণেই তদন্ত কর্মকর্তা তাকে আদালতে নিয়ে আসেন।
কৌশল খাটিয়ে আইনের এই সুবিধাটি নেয়ার জন্য মনে মনে ফন্দি এঁটেছিলেন এসআই জাহিদ। কিন্তু সেই সুযোগ একচ্ছত্রভাবে কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। ফের রিমান্ডে নেয়ার আইনগত সুযোগটি হাতে রয়েছিল তদন্তকারী কর্মকর্তারও। স্বীকারোক্তি দিতে এসে বেঁকে বসায় তাকে আবারো রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত শুনানি শেষে সে আবেদন মঞ্জুরও করেন। এ নিয়ে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডে গেলেন এসআই জাহিদ।
এর আগে তিন দফায় রিমান্ডে নেয়া হয় এসআই জাহিদ ও সোর্স নাসিমকে। এর মধ্যে গত ২৭ জুলাই ৩ দিনের, ২৩ জুলাই ৪ দিনের, ১৭ জুলাই ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় তাদের।
উল্লেখ্য, গত ১২ জুলাই রাতে ব্যবসায়ী সুজনকে তার ধানমণ্ডিস্থ শংকরের বাসা থেকে মিরপুর থানায় ধরে নিয়ে যান এসআই জাহিদ। পরে সুজনকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হন এই পুলিশ সদস্য। এই অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার পথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন সুজন। এ অবস্থায় সুজনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় এসআই জাহিদকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে ঘটনার তদন্তে মিরপুর বিভাগের এডিসিকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে পুলিশ।
মামলার দীর্ঘ এজাহার থেকে জানা যায়, গত ১৩ জুলাই এসআই জাহিদুর রহমান ও সোর্স নাসিম আটককৃত মাহবুবুর রহমানকে থানা হাজতে না রেখে নিজ হেফাজতে রাখেন এবং মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে মহিলা হাজতখানায় রাখেন। এরপর রাত ৩টা ৪৩ মিনিটে ভিকটিমকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হন। ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে এসআই জাহিদ মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন খানকে মোবাইল ফোনে জানান, সুজনের বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় হাসপাতালে নিলে তার মৃত্যু হয়।
ক্লিনিক ও হাসপাতালের কথা বলা হলেও কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এজাহারে তার কোনো উল্লেখ নেই।
এজাহার থেকে আরও জানা যায়, লাশের ময়না তদন্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আ খ ম শফিউজ্জামান মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করেন, ‘In my opinion death was due to haemorhage & shok as a result of above mentioned injury which were antemortem & homicidal in nature’। ময়না তদন্ত রিপোর্ট ও সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, মৃতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন বিরাজমান ছিল।
এছাড়াও এজাহারে উল্লেখিত সুজনের স্ত্রীর বক্তব্য হলো, বাসায় অভিযানকালে সুজনকে বাথরুমের দরজা আটকিয়ে পেটানো হয়। থানায়ও তার স্বামীকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তিনি তার স্বামীর চিৎকার শুনেছেন।
এ ঘটনায় নিহত মাহবুবুর রহমানের সুজনের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুচি বাদী হয়ে গত ২০ জুলাই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মিরপুর মডেল থানার ওসিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ মামলার আসামিরা হলেন, মিরপুর মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিন, এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এ.এস.আই রাজ কুমার, কনস্টেবল আসাদ, রাশেদুল, মিথুন, সালাউদ্দিন আহম্মেদ, নাসিম, ফয়সাল, খোকন ও পলাশ। মামলায় বাদীনিসহ মোট ৬ জন সাক্ষিও রয়েছে। সাক্ষিরা হলেন বাদীনি নিজে, নজরুল ইসলাম শামীম, শাহিদা বেগম, মাহবুব আলম, মো. সাইফুল ইসলাম ও মিনহাজ।