নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সামাজিক ব্যবসার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অনেক সম্ভাবনাময়। চট্টগ্রামে সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ অনেকদূর এগিয়েছে। চট্টগ্রাম সামাজিক ব্যবসায় নেতৃত্ব দেবে। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত সামাজিক ব্যবসার গ্লোবাল সামিটে এখান থেকে প্রতিনিধিদল যাবে।
গত সোমবার নগরীর এন মোহাম্মদ কনভেশন সেন্টারে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সুহৃদ–চট্টগ্রাম আয়োজিত ইফতার মাহফিলে তিনি এ কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ ব্যবসা জানে। বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছি, কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের মতো উদ্যোগী মানুষ কোথাও দেখতে পাইনি। এখানকার মানুষের মধ্যে সবসময় সৃজনশীল চিন্তা–ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার চট্টগ্রাম কেন্দ্র আমাদের হৃদয়ে আশার সঞ্চার করে। একদিন এ কেন্দ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বিশ্ব শ্রেষ্ঠ হবে। সারা বিশ্ব চট্টগ্রাম কেন্দ্রকে অনুসরণ করবে।
মায়ানমারকে সার্কভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন,আশিয়ান অনেক সফল হলেও একই আঙ্গিকে গঠিত সার্ক তেমন কোনো কাজে আসেনি। দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী সংগঠন সার্ক এখন অনেকটা অচল। এর কারণ হচ্ছে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কমে গেছে, হারিয়ে গেছে এক দেশের প্রতি আরেক দেশের আগ্রহ। কাজেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সার্ক কার্যকর হলে আরো বেশি সুফল মিলত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করে তিনি বলেন, মোদি নির্বাচিত হওয়ার পর সার্কভুক্ত দেশগুলোকে একত্র করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের নেতারাও একত্র হয়েছেন। ঐক্যের একটি সংস্কৃতি পুনরায় চালু করছেন। এটি খুব প্রশংসনীয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে পারস্পরিক উন্নয়ন হচ্ছে না। এর ফলে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে যেতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সব আছে, শুধু ঐক্যের অভাব।
মায়ানমারকে খনিজ সম্পদে ভরা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু সামরিক শাসন দেশটিকে দুনিয়া থেকে বিচ্যুত করে দিয়েছে। মায়ানমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর এগোতে পারেনি। গার্মেন্টস শিল্পের একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটি এখন শূন্যের কোটায়। কিন্তু অবস্থা পাল্টাতে শুরু করেছে। খনিজ সম্পদে ভরপুর দেশটিতে বর্তমানে চীন আসছে, জাপান আসছে। আমাদের অতি নিকট প্রতিবেশী এই দেশটির দিকে আমাদের আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।
তিনি গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এই বন্দর চীন,মিয়ানমার এবং আমাদেরকে একই পরিবারভুক্ত করবে। মতভেদ, মতপার্থক্য এবং বৈচিত্র্য নিয়েই সংসার। এভাবেই গড়ে উঠতে হবে।
মারামারি করে পারস্পরিক উন্নয়ন সম্ভব নয় মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, এজন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোকে একটি অর্থনৈতিক কমিউনিটির ভেতর চলে আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে। তিনি সম্পদশালী দেশ মায়ানমারকে সার্কভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এদেশের অনেক সম্পদ আছে,অনেক সম্ভাবনা আছে। একদিন এই দেশ তরতরিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে উপরে চলে যাবে।
বাংলাদেশে নারী ও তরুণদের প্রশংসা করে ইউনূস বলেন, আমাদের দেশের নারী ও তরুণরা বিভিন্ন কাজে ব্যাপক সফলতা অর্জন করছে, যা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের কাছে প্রশংসনীয়। তারা আমাদের কাছ থেকে শিখতে চায়। তিনি তরুণদের আরো সৃজনশীল হওয়ার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের তরুণরা সামাজিক ব্যবসায় একদিন বিশ্বে মডেল হবে বলেও তিনি আশবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস ভ্যাটিকান সিটি সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অর্থনীতি এবং মানবকল্যাণ নিয়ে পোপের সাথে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, দান–খয়রাতের আরো নানা ফর্ম আছে, অনেক বেশি আকর্ষণীয় ফর্ম রয়েছে। দান–খয়রাতের নামে মানুষকে পরনির্ভরশীল করে তোলা ভালো কথা নয়। মানুষের ধর্ম অপরের ওপর নির্ভরশীল করা নয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের বোঝা বহন করা হচ্ছে ধর্ম। দান–খয়রাতের মাধ্যমে মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্যুত করা হচ্ছে। এই বক্তব্য পোপের পছন্দ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বেকারত্ব একটি নকল জিনিসণ্ডমন্তব্য করে প্রফেসর ইউনূস বলেন, বেকারত্বের মতো নকল জিনিস সৃষ্টি করে মানুষকে অবশ করে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপে অর্ধেক তরুণ বেকার। বেকারত্বের ধারণা পাল্টে দিতে হবে। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটি শক্তি আছে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সুহৃদ–চট্টগ্রাম–এর সভাপতি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মু. সেকান্দর খান। তিনি বলেন, ড. ইউনূসের ওপর পরিচালিত নানা অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজেদের তাগিদ থেকে ইউনূস সুহৃদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা এটিকে সামাজিক ব্যবসার একটি বিধিবদ্ধ এবং কল্যাণমূলক একটি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। নয়জন মানুষ নিয়ে আমরা চট্টগ্রামে ইউনূস সুহৃদ নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আজ পুরো চট্টগ্রাম এই সংগঠনের সাথে একাত্ম। এটাই এই সংগঠনের সার্থকতা। কোন নেতা কী বললেন, কোন রাজনীতিবিদ কী করলেন তাতে মানুষের কিছু আসে যায় না। মানুষ তার প্রিয় স্বদেশকে এগিয়ে নেবে।
অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীকে সাথে নিয়ে মঞ্চে আসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক। কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনুর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।