গত এক-দেড় মাসে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিনের খবরের বড় অংশজুড়ে ছিল আন্দোলন নিয়ে বিএনপি ও সরকারের হুমকি-পাল্টাহুমকি। বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে একই কথা প্রতিদিন শুনতে হয়েছে, ‘ঈদের পর আন্দোলন হবে’ আর ‘আন্দোলন ঠেকানো হবে’। দুই পক্ষেরই গলাবাজি করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা।
অন্যদিকে জনগণের জীবন চলেছে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা, যানজট, দ্রব্যমূল্য, খুন, গুম, ক্রসফায়ার, রিমান্ড, চাঁদাবাজি, ছিনতাই নিয়ে আতঙ্কে-উদ্বেগে। সরকারের এখন একচেটিয়া ক্ষমতা। বিরোধী দল নেই, সুতরাং দখল, চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলেরই বিভিন্ন গ্রুপের মরণপণ সংঘাত চলছে দেশের নানা প্রান্তে। সরকারের নানা সিদ্ধান্তও চলছে একতরফা। সুন্দরবন ধ্বংসের নানা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বিশাল সমুদ্রসম্পদ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে অতীতেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এখনো সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
অথচ ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও চীনের কোম্পানিগুলোর লবিস্টদের প্রচার-প্রচারণার তৎপরতা বেড়েছে। সরকারের লোকজন তাদের সুরেই কথা বলছে। জ্বালানি খাতে দুর্নীতি ও ভুল নীতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন যাতে কেউ না তুলতে পারে, কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া যায়, তার জন্য সরকার আবারও দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ আরও চার বছর বৃদ্ধি করছে। পরীক্ষায় দুর্নীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, সন্ত্রাস—সবকিছুতেই সরকারের অস্বীকারের প্রবণতাও এখন আরও বেড়েছে।
পোশাকশ্রমিকসহ অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের কাজ ও মজুরি নিয়ে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতা তো বরাবরের বিষয়। এর চরম চেহারা দেখা গেছে তোবা গ্রুপে। বিশ্বকাপের জার্সির কাজ পেয়েছিল এই গ্রুপের কয়েকটি কারখানা। শ্রমিকেরা কাজও করেছেন। মজুরি বকেয়া থাকায় এর আগেও শ্রমিকেরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আবার কাজে যোগও দিয়েছেন। গত ১৭ মে তোবা ফ্যাশনসের কারখানার ম্যানেজার তাঁর স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্যে শ্রমিকদের গত এপ্রিল মাসের বেতন ২০ মের মধ্যে এবং মে মাসের বেতন ১০ জুনের মধ্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মে মাসের বেতন আবার বকেয়া হয়।
২৬ জুন তোবা গ্রুপের পাঁচটি কারখানার পরিস্থিতি নিয়ে বিজিএমইএর প্রতিনিধিসহ তাদের অডিটরিয়ামে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী মে মাসের মজুরি ৩ জুলাই, জুন মাসের মজুরি ১৫ জুলাই, ঈদ বোনাস ও জুলাই মাসের ১৫ দিনের মজুরি ২৬ জুলাই দেওয়ার কথা। এই চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকেরা ২৭ জুন থেকে আবারও বিপুল উদ্যমে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এবারও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়। এর মধ্যে অর্ডারের সব কাজ শেষ হয়, সেগুলো বিশ্বকাপের আনন্দ বৃদ্ধি করে। আর তখনই মালিকপক্ষ জানায়, তাদের টাকা নেই। ব্যবসা হয় ৬০ কোটি টাকার, চার কোটি টাকার মজুরি দেওয়ার টাকার আকাল! মালিক, বিজিএমইএ ও সরকারের যৌথ প্রযোজনার নির্মম খেলায় বলি হন শ্রমিকেরাই। যে ছুটির সময় স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা, সে সময় তাঁদের থাকতে হলো অনশনে। পোশাকমালিকদের রক্ষার জন্য আছে শিল্প পুলিশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের পাওনা অধিকার থেকে যখন বঞ্চিত হয়, তখন তাই সরকারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
এখনো রানা প্লাজায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। নীতিমালাও হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে শ্রমিকদের সহায়তার নামে তোলা ১০০ কোটি টাকার ওপর এখনো পড়ে আছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ সরকারের কাছ থেকে তিন হাজার কোটি টাকার বাড়তি সুবিধা আদায় করেছে, মার্কিন সরকার সাত হাজার কোটি টাকার শুল্ক আদায় করেছে, ব্র্যান্ডগুলো তাদের মুনাফা আরও বাড়িয়েছে। আর শ্রমিকদের জন্য ঈদের ‘উৎসব’ গেল রানা প্লাজায় বিপর্যস্ত কয়েক হাজার পরিবারের সঙ্গে মজুরি ও বোনাস না পাওয়া অসংখ্য শ্রমিকের আহাজারি ও ক্ষোভ নিয়ে।
আমাদের দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এত উৎসাহ, এত উচ্ছ্বাস, এত পতাকাযুদ্ধ! কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সারা দেশের খেলার মাঠ দখলমুক্ত করার দাবি ওঠে না ঠিকমতো। এত উচ্ছ্বাস জার্সি নিয়ে, অথচ সেই জার্সি সেলাই করেন যে শ্রমিকেরা, তাঁদের মজুরি যে মাসের পর মাস অনাদায়ি থাকে, সে বিষয়ে সমাজে মনোযোগ দেখা যায় না।
উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে নদী, বন, মাঠসহ দেশের সম্পদ দখল ও বিনাশ করে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী। অথচ এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চিন্তা ও শ্রমে সারা সমাজে এখনো অনেক আলস্য।নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এই অমনোযোগ আর নিষ্ক্রিয়তার ফাঁকেই তৈরি হয় ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার ক্যারিকেচার।কৃত্রিম গলাবাজি আর স্বার্থের ঐক্যের রাজনীতির ডিগবাজি।