জনপ্রিয় ও নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের স্কুল শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ। তিনি আমাদের মাঝে নাই কিন্তু আছে তার হাতে গড়া সেই বিদ্যাপীঠ।
গ্রামের নাম কুতুবপুর। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইল বাড়ি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম এটি। এ গ্রামের আশেপাশে তখন কোনো বিদ্যালয় ছিলনা। তাই বহু পথ পাড়ি দিয়ে পরের বাড়িতে জায়গীর থেকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের বাবা। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ। মা আয়েশা ফয়েজের মুখে এমন গল্প শুনে ও মায়ের অনুরোধে এলাকার শিক্ষাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সিদ্ধান্ত নেন কুতুবপুর গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার।
অবশেষে ১৯৯৬ সালে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন তার স্বপ্নের স্কুল শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের। বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর (বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী) এ বিদ্যাপীঠের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তারপর বিশাল জায়গা জুড়ে শুরু করেন ভবন নির্মাণের কাজ। স্কুল ভবনের ডিজাইন করে দেন, তার সহধর্মি
নী মেহের আফরোজ শাওন। ২০০২ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়।ভবনের সামনে রাখা হয় বিশাল খেলার মাঠ। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নির্মাণ করা হয় স্মৃতি ফলক। এ স্মৃতি ফলকে উল্লেখ করা হয় হুমায়ূন আহমেদের বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ, শহীদ মুখলেছুর রহমান খান পাঠান, শহীদ মুখলেছুজ্জামান ও শহীদ আব্দুল লতিফ মাস্টারের নাম।
বিশিষ্ট কবি শামসুর রাহমান এ স্মৃতিফলকের উদ্বোধন করেন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের স্মৃতি রক্ষার্থেই মূলত হুমায়ূন আহমেদ তার স্কুলের নাম দেন শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ।
স্কুল নির্মাণের যাবতীয় কাজ যখন শেষ তখন তিনি চিন্তা করেন, এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান তার পক্ষে একা চালানো সম্ভব নয়। তাই তিনি সরকার কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থাকে স্কুলের দায়িত্বভার হস্তান্তরের জন্য চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকার বা কোনো সংস্থা তার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাননি।
অবশেষে ২০০৮ সালে তিনি নিজ উদ্যোগেই মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেন স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম। বর্তমানে এ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থী সংখ্যা রয়েছে ৩০৮ জন এবং ১৫ জন শিক্ষক ও ২ জন কর্মচারী। শুরু থেকেই স্কুলটির ফলাফল অত্যন্ত ভালো। মেধা তালিকায় স্থান অর্জনসহ স্কুলটির ফলাফল এখন শতভাগ। স্কুলের শুরু থেকে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি নিজেই স্কুল সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন তার সহধর্মিনী মেহের আফরোজ শাওন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে স্কুলটিকে এমপিওভুক্তিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় দেশের প্রতিথযশা অনেক কবি সাহিত্যিক ও সরকারের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তারা অজপাড়গাঁয়ের এ বিদ্যাপীঠে এসে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে খুশি করলেও আজ আর কেউই কোনো খোঁজখবর নেন না।
হুমায়ূনবিহীন কুতুবপুরের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠটি যেনো এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হুমায়ূন আহমেদের কত স্বপ্নই না ছিল এ স্কুলকে ঘিরে।
হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রায়ই গর্ব করে বলতেন, ‘তোমরা দেখে নিও, একদিন এ স্কুলটি দেশ সেরা বিদ্যাপীঠে পরিণত হবে। এর সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তখন শহরের ছেলে মেয়েরাও এখানে পড়াশোনা করতে আসবে। এ স্কুল একদিন দেশে হৈচৈ ফেলে দিবে’।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত এ বিদ্যাপীঠটি এমপিও ভুক্ত হয়নি।
শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান জানান, বর্তমানে বিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ স্কুলকে ঘিরে হুমায়ূন স্যারের অনেক স্বপ্ন ছিল। স্যার তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে হুমায়ূন স্যার বেঁচে থাকতে স্কুলটি সব সময় জমজমাট থাকতো। স্যারের সঙ্গে সরকারের অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও জ্ঞানীগুনী লোকজন এখানে এসেছেন এবং স্যারের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু স্যারের মৃত্যুর পর আজ আর তেমন কেউ আমাদের খোঁজটুকুও নেন না। এমপিওভূক্তি না হওয়ার কারণে শিক্ষকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।