সরকার টিভি চ্যানেলের আলোচনামূলক অনুষ্ঠান (টকশো) নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি মনে করছে। টকশোগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় সংশ্লিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সর্বোচ্চ মহল থেকে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে।
বক্তারা অভিযোগ করেন, সরকার সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে এখন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চায়। আর যদি সেটা করা হয়, তবে এর পরিণাম হবে সরকারের জন্য বিপজ্জনক। নীতিমালা যা-ই করা হোক না কেন, আমাদের কথা বলা বন্ধ করা যাবে না। আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাবো। হুমকি, ধমকি দিয়ে আমাদের কন্ঠরোধ করা যাবে না।
রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলে সরকারকে হুশিয়ারি দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। নাগরিক ঐক্যের আয়োজনে বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘নিয়ন্ত্রণমূলক সম্প্রচার নীতিমালা জনগণ মানবে না’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। এসময় বক্তারা বলেন, শাসকদলের দোষত্রুটি তুলে ধরার পাশাপাশি যেকোন পরিস্থিতির বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষনের ফলে টিভি চ্যানেলের টকশোগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তাই এটা নিয়ে সরকারের মাথাব্যাথা শুরু হয়েছে। ফলে কোন ধরনের সম্প্রচার নীতিমালা গঠনের অপেক্ষা না করে এ সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে দেরি করেনি। এ যেনো ডিমের আগেই বাচ্চা হওয়ার মতো ঘটনা বলেও উল্লেখ করেন তারা।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। তাই মানুষকে শৃঙ্খল পরানো উচিত নয়। তিনি বলেন, এই সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে দেশ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিনত হবে।সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন,দেশে একটি সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে।
তবে তা অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। এর আগেও বিভিন্ন সময় নীতি মালা হয়েছে। বর্তমানে এটি একটি রোগে পরিনত হয়েছে। তিনি বলেন, এই নীতিমালার সঙ্গে সংবিধানের কোন মিল নেই। তাই এ কোন অবস্থায়ই নীতিমালা টিকতে পারবে না।
আলোচনা সভায় বিশিষ্ট আইনজীবি শাহদীন মালিক বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে যারা বৈধ বলে তাদের টিকে থাকার জন্য এধরনের আইন বা নীতিমালা করতেই হবে। জনগনের সাথে যাদের সম্পর্ক থাকে না তাদেরকেই প্রশাসন ব্যবহার করে কিংবা কালো আইন তৈরী করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়। তিনি বলেন, গনতন্ত্রের স্বার্থে এই নীতিমালাকে প্রতিহত করতে হবে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজন আছে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান, ১৯৮৬ সালে এরশাদ এবং ২০০৩ সালে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। তবে কোনো নীতিমালা সাংবাদিকেরা মানেননি। তিনি বলেন, বর্তমান মুক্তবিশ্বে নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা যায় না। বর্তমান সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা টিকতে পারবে না।
আলোচনায় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, বর্তমান সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যম সম্পর্কিত নয়। এটা রাজনৈতিক। সরকার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের মতো করে সব গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরতে চায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার অস্বস্তিতে পড়ার কারণে একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ তার কোনো কর্মসূচিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
মুহম্মদ জাহাঙ্গীর আশঙ্কা করেন, সরকার হয়ত দু/একটি সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র অচিরেই বন্ধ করে দেবে। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার বিটিভিকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সে কারণে ২৫টি বেসরকারি টেলিভিশনকে নিজের মতো করে পরিচালিত করতে চায়। আর সেটি হলে দেশের মানুষ টেলিভিশন দেখা ছেড়ে দেবে। তিনি বলেন, বর্তমান নীতিমালা আইনে পরিণত হলে টেলিভিশনের উপস্থাপক, প্রযোজক ও টক-শোর আলোচকদের হয়রানি করার সুযোগ থাকবে বেশি।
তবে ভুল তথ্য দেওয়ার অধিকার কারো নেই। তার মতে, বর্তমান সরকার দুটি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। এক, জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করতে পেরেছে। দুই, বিএনপিকে দুর্বল করতে পেরেছে। বাকি ছিল শুধু গণমাধ্যম। এখন সেটিও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।আন্দোলনের মাধ্যমে এ অপচেষ্টা প্রতিরোধের আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের(১৯৯৬-২০০১)সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়ীদ, ড. আসিফ নজরুল, নিউ নেশন পত্রিকার সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিআর আবরার, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার,সাংবাদিক সালেহ উদ্দীন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।