১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে গোপন তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ নেই। তিনি ‘ক্ষমতাচ্যুত’ হয়েছেন এবং ‘খন্দকার মুশতাক আহমেদ তার স্থলাভিষিক্ত’ হয়েছেন বলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও ওই তারবার্তায় বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ব্যাপারে অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে। অথচ তারবার্তাটি পাঠানো হয় হত্যাকাণ্ডের আট ঘণ্টা পর।
বিশ্বের সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন বিভিন্ন গোপন তারবার্তায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ওয়াশিংটনে তিনটি তারবার্তা পাঠিয়েছিল ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পাঠানো প্রথম বার্তায় লেখা হয়েছে-
১. আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বেতারে একটি রেকর্ডকৃত ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। ঘোষণাটি দিচ্ছেন একজন আর্মি মেজর। সেখানে বলা হচ্ছে, শেখ মুজিব সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে খন্দকার মুশতাক আহমেদ তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। মুজিব সরকারের মন্ত্রীদের বন্দী করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রাইফেলস (তৎকালীন বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) এবং রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অথবা পরবর্তী দায়ভার নিজেদেরই নিতে হবে।
২. মনে হয়, ভোর সাড়ে ৫টার ঠিক আগে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসায় সেনা অভ্যুত্থান শুরু হয়। অভ্যুত্থান শেষ হলেও সকাল ৭টা পর্যন্ত মুহুর্মুহ গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সাড়ে ৫টায় মুজিবের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ির দিকে ভারি গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। প্রতিবেশীরা বলছেন, তিনি নিহত হয়েছেন। তবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
দূতাবাস থেকে চেন্সারির রাস্তায়, সেনানিবাসের আশপাশের আবাসিক এলাকা, সেনানিবাসের দক্ষিণ দিক এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (রূপসীবাংলা) কাছাকাছি অনেকগুলো ট্যাংকের উপস্থিতি দেখা গেছে।
দূতাবাসের বাঙালি নিরাপত্তা সহকারী জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের শ্যালক সেচমন্ত্রী সেনিয়াবাত খুন হয়েছেন।
৩. আমরা যতদূর বুঝতে পারছি, ২৪ ঘণ্টার একটা কারফিউ জারি করা হয়েছে অথবা জারি হতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা দূতাবাসের সম্পদের ওপর কোনো হুমকি বা ঝুঁকি আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রায় এক ঘণ্টার মাথায় ২টা ২৫ মিনিটে পাঠানো হয় দ্বিতীয় বার্তা। এখানে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। বার্তাটি বাংলাদেশ বেতারের ঘোষণা দিয়ে শুরু করা হয়েছে:
সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। মুজিবের নির্বোধ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না বলে আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি। আপনারা শান্তভাবে ঘরে অবস্থান করুন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বের হবেন না। আমরা সাধারণ জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছি। যদি কেউ নির্দেশ অমান্য করে তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোকে অনুরোধ করছি।
সন্ধ্যা ৬টায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তৃতীয় তারবার্তায় পাঠানো হয়। এতে বলা হয়:
ঢাকা সময় বেলা ১১টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, সামরিক অভ্যুত্থান সফলভাবেই অগ্রসর হবে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের নিকটবর্তী এলাকায় থেমে থেমে গুলি চললেও রাস্তাঘাট শান্ত আছে।
বাংলাদেশ বেতারের ঘোষণা অনুযায়ী, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশকে নিকটস্থ সেনাকেন্দ্রে রিপোর্ট করতে নির্দেশ দিয়েছে সেনাবাহিনী। এই মুহূর্তে প্রতিপক্ষ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ হওয়ার লক্ষণ নেই। চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বন্দরনগরী খুবই শান্ত আছে।
গুটিবসন্ত নির্মূল বিষয়ক চিকিৎসক আমাদের জানিয়েছে, বিভিন্ন রেডিও সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিস্তৃত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কোথাও কোনো অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়নি।
আমরা অবশ্য এখনো কিছু প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান সফল বলেই মনে হচ্ছে।
এখন সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, বাংলাদেশে রাইফেলসের প্রধান এবং পুলিশ প্রধানের মাধ্যমে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানো কথা রেডিওতে ঘোষণা করা হচ্ছে।
২. এখন পর্যন্ত মার্কিন কোনো নাগরিক বা মার্কিন স্থাপনা-সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষয়তির সংবাদ পাওয়া যায়নি। মার্কিন মিশনের প্রায় সবাই টেলিফোন বা রেডিওর মাধ্যমে দূতাবাসে যোগাযোগ করেছে এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীদের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অভ্যুত্থান কোনদিকে গড়ায় তার ওপরই পরিস্থিতি নির্ভর করছে।
৩. নতুন সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়নি।
চতুর্থ বার্তাটি পাঠানো হয় রাত ৮টা ৫ মিনিটে। তৎপর মার্কিন দূতাবাস এই বার্তায় খন্দকার মুশতাকের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ওয়াশিংটনে পৌঁছে দেয়। পাঠানো বার্তায় মুশতাককে মার্কিনপন্থি এবং ভারত ও সোভিয়েত বিদ্বেষী বলে অভিহিত করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
মুজিব সরকারের অর্থমন্ত্রী মুশতাক দেখতে ছোটখাট একটা মানুষ। তবে রাষ্ট্র চালানোর মতো যোগ্যতা, তৎপরতা এবং শেখ মুজিবের ক্যারিশমার ধারে কাছে নেই তিনি। মুজিব সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন তাজউদ্দিন বিরোধী এবং মার্কিনঘেঁষা।
এর আগে, উইকিলিকসের ফাঁস করা আরেক গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্টের তিন মাস আগেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালের ২১ মে’র ওই হত্যাচেষ্টার খবর প্রকাশ না করতে গণমাধ্যমকে নির্দেশ দিয়েছিল।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে ১৯৭৫ সালের ২৩ মে পাঠানো ওই তারবার্তায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ২১ মে ঢাকার উপকণ্ঠে নতুন টেলিভিশন স্টেশন পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় নিজ বাসভবনে ফেরার সময় তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। শেখ মুজিব অক্ষত আছেন। তবে অজ্ঞাতপরিচয়, দু’জন আহত হয়েছেন। তথ্য অধিদপ্তর এ সংক্রান্ত খবর না ছাপাতে গণমাধ্যমকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।