বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের পণ্য পরিবহন সুবিধা নিয়ে আলোচনা চলার মধ্য দিয়েই এবার ভারতে ট্রানজিট সুবিধা চাইছে বাংলাদেশ। উদ্দেশ্য, ভারতের করিডোর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাক পাঠানো।
বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। পরে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ সভায় তোফায়েল আহমেদ বলেন, নেপাল ও ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারলেও বাংলাদেশের কোনো ট্রাক নেপাল ও ভুটানে যেতে পারছে না। এ ধরনের সুবিধার জন্য ভারতের সঙ্গে পৃথক চুক্তি দরকার।
বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ কে বলেন, ‘নেপাল ও ভুটান দুটি দেশের সঙ্গে ভারতের ট্রানজিট চুক্তি রয়েছে। এ কারণে ওই দেশ দুটির পণ্যবাহী যান ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহার করে অনায়াসে আমাদের এখানে প্রবেশ করছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ভারতের এ ধরনের কোনো চুক্তি নেই তাই আমরা পারছি না। এখন সেই চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এমনটি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি খুব দ্রুতই এটি হয়ে যাবে।’ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহারে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি এমন একটি সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যখন ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নিয়মিত খাদ্য পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চাইছে ভারত।
এরই মধ্যে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে ১০ মেট্রিক টন খাদ্য ত্রিপুরায় পাঠানো হয়েছে। খাদ্য পরিবহনের এ চালান নিয়মিত করে দেশটি চাইছে প্রতি মাসে অন্তত ৩৫ মেট্রিক টন খাদ্য বাংলাদেশ দিয়ে ত্রিপুরায় পাঠাতে। উপরন্তু বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় যোগাযোগ সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার।
সূত্র জানায়, ভারতের পাশাপাশি নেপাল এবং ভুটান চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার জন্য সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এ সুবিধা দেওয়া হলে পাশের দেশ দুটির বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবহন হবে দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর দিয়ে। তবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যদি সংশ্লিষ্ট দেশ দুটির যান ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে খুব বেশি লাভবান হবে না বাংলাদেশ। বরং বাংলাদেশি যান ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন করার সুযোগ সৃষ্টি হলে এ খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও লাভবান হবে। সরকারের এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভারতে ট্রানজিট সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। বর্তমানে এ দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি হয় ভারতের করিডোর ব্যবহার করে। নেপাল থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে রোহানপুর ও সিঙ্গাবাদ পয়েন্ট এবং ভুটানের সঙ্গে বুড়িমারী ও ফুলসুলিং বন্দর ব্যবহার করা হয়। এ দুটি পয়েন্টে যেতে গেলে ভারতের ৪০-৫০ কিলোমিটার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হয়। তবে ভারতের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের ট্রানজিট সম্পর্ক থাকায় এ দুটি দেশের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারলেও বাংলাদেশের কোনো ট্রাক সে সুযোগ পায় না।
জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে করা এক চুক্তির বিপরীতে নেপালি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। তবে ওই সময়ের চুক্তিতে যান চলাচলের কোনো মডালিটিজ না থাকায় ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মডালিটিজ চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকের রূপরেখা অনুসারে বাংলাবান্ধা-পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-সৈয়দপুর-রংপুর-বগুড়া-নাটোর-দাশুরিয়া-পাকশী-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর এবং খুলনা হয়ে মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় নেপালকে। একই পথে ভুটানকেও ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহারে (ট্রানজিট) চুক্তি করতে না পারে তবে নেপাল ও ভুটানকে দেওয়া এ সুবিধা থেকে তেমন কোনো বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জানান, ভারতে ট্রানজিট সুবিধা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারত নেপাল ভুটান- এ চারটি দেশের একে-অন্যের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ সুবিধা চালু হলে কেবল বাণিজ্যিক বৈষম্য কমবে এমন নয়, বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেমন আঞ্চলিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ অনেক কিছুতেই একসঙ্গে কাজ করতে পারবে এ অঞ্চলের দেশগুলো।