দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ আর মাত্র তিনদিন। ২৭ আগস্ট থেকে শুরু হচ্ছে প্রথম হজ ফ্লাইট। কিন্তু এখনও ভিসা হয়নি। শেষ হয়নি সব হাজীর পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজও।
এর মধ্যেই হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশনের (হাব) বিরুদ্ধে হাজীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। হাজীদের জিম্মি করে সার্ভিস চার্জসহ নানা খাত দেখিয়ে এজেন্সিগুলোরে মাধ্যমে সংগঠনটি ইতিমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। আগেভাগেই এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে রসিদমূলে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এসব টাকা আদায় করা হয়েছে। টাকা দিতে গড়িমসি করলে এজেন্সিগুলোকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় বলেও অভিযোগ আছে।
জানা গেছে, ভিসা প্রসেসিং, থাকা-খাওয়া এবং হাজীদের আনা-নেয়াসহ সবকিছুই দেখাশোনা করে থাকে হজ এজেন্সিগুলো এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়। সরকারিভাবে প্রতি হাজীর কাছ থেকে নির্ধারিত প্যাকেজের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ, হজ ট্রেনিং, আপত্কালীন ফান্ডসহ সবকিছুই আদায় করা হয়ে থাকে। কিন্তু এরপরও হজ এজেন্সিগুলোর ওপর খবরদারি করে হাব এবারও সার্ভিস চার্জ আদায়ের নামে প্রতি হাজীর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ৯৭ হাজার ২০৫ জন ননব্যালটির কাছ থেকে মোট ৯৭ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করেছে।
এছাড়া ট্রলি ব্যাগ দেয়ার নামে একেবারে নিম্নমানের একটি ব্যাগ সরবরাহ করে বাধ্যতামূলকভাবে ৯৭ হাজার ২০৫ জন ননব্যালটির কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ১৭০০ টাকা করে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। অথচ হাজীদের অভিযোগ, আমাদের কাছ থেকে ১৭০০ টাকা নিয়ে যে ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে তা খুবই নিম্নমানের। বাজারে এর দাম একেবারেই কম। ব্যাগটি সৌদি আরবে গিয়ে হজ করে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত ব্যবহার করার উপযোগী নয়। বাধ্য হয়েই তাদের এ ব্যাগ নিতে হচ্ছে। গতবারও একই ব্যাগ দিয়ে তারা বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া ১০০ টাকা সার্ভিস চার্জের নামে যে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাতে হাব হাজীদের কোনো সেবায় আজ পর্যন্ত লাগেনি। সার্ভিস চার্জের নামে সংগঠনটি হাজীদের জিম্মি করেই এ বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাত্ করে বলেও হাজীদের অভিযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হজ এজেন্সিগুলো জানায়, হাব হাজীদের কোনো সেবায় থাকে না। তারপরও হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর দুই মাস আগেই সংগঠনটি সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে এজেন্সিগুলোকে বাধ্য করে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ হাজী আনা-নেয়ার মধ্যে তাদের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। সরকার স্বীকৃত কোনো তদারকি প্রতিষ্ঠানও নয় এ সংগঠনটি। তারপরও হাজীদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে হাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হজ এজেন্সি জানায়, তারা প্রতি হাজীর মাথাপিছু সার্ভিস চার্জ, ট্রেনিং ফি, আপত্কালীন ফান্ডসহ সরকারের নির্দিষ্ট খাতে টাকা জমা দিয়েছে। কিন্তু এরপরও হাব প্রতি হাজী মাথাপিছু বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ বাবদ ১০০ টাকা, ব্যাগ বাবদ ১৭০০ টাকাসহ অন্যান্য খাতে টাকা আদায় করেছে। আরও দুই মাস আগে এসব টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, হাবের চাঁদাবাজির বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কোনো কোনো কর্মকর্তা জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বরং হজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেসব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সখ্য রয়েছে। তাদের যোগসাজশে সংগঠনটি ইচ্ছামত টাকা আদায় করছে।
এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (হজ) মো. জাহাঙ্গির আলম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ কে জানান, হাজীদের আনানেয়াসহ সবকিছুই করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এখানে হাবের কোনো কাজ নেই। হজের নামে তাদের টাকা পয়সা লেনদেন করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কোনো হাজী কিংবা এজেন্সির পক্ষ থেকে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
সরকার নির্ধারিত টাকা-পয়সার বাইরে বিভিন্ন খাতে হাজীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আলহাজ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বর্তমানকে বলেন, ‘বিষয়টি ধর্মমন্ত্রণালয়ের দেখাশোনা করার কথা। হাজীদের কাছ থেকে কী কারণে হাব টাকা নিচ্ছে তা তাদেরই দেখা দরকার। তারপরও এ বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখবো। কোনো অনিয়ম প্রমাণ হলে এবং এর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
তবে হাজীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে টাকা আদায়ের বিষয়টি জানতে হাবের সভাপতি ইব্রাহিম বাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দোয়া মাহফিলে আছেন বলে কথা বলতে রাজি হননি। সংগঠনটির মহাসচিব শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রথম বাংলাদেশকে কে বলেন, তারা সার্ভিস চার্জ বাবদ যে ১০০ টাকা নেয়, তাতে হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাজীদের সেবা করে থাকেন। তার দাবি, সৌদি আরবে কোনো হাজী বিপদে পড়লে, হারিয়ে গেলে এ ফান্ড থেকে সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। হাজীদের কাছ থেকে সার্ভিস বাবদ নেয়া টাকায় সৌদি আরব এবং দেশে সংগঠনটির কার্যালয় ও কর্মচারীদের ব্যয়ভার বহন করা হয়। তাছাড়া এজেন্সিগুলোর সুযোগ-সুবিধা ও বিপদ-আপদে হাব সব সময় কাজ করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ব্যাগ বাবদ ১৭০০ টাকা আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা এজেন্সিগুলোর অনুরোধে একই রঙের ব্যাগ সরবরাহ করেছে। টেন্ডারের মাধ্যমে বাজার মূল্যে ভালো মানের ব্যাগ হাজীদের দেয়া হয়েছে। অন্যান্য খাত প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতির সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, হজ এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে প্রতি ৫০ জন হাজীর বিপরীতে একজন হজগাইডের জন্য চাঁদা বাবদ ৩ হাজার টাকা করে ৩ বছরের জন্য ননব্যালটি হাজীদের কাছ থেকে আরও প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হাব। এবার যেসব এজেন্সি নতুন এবং যে সব এজেন্সি হজগাইড পরিবর্তন করেছে তাদের সবাইকে প্রতি ৫০ হাজীর বিপরীতে একজন গাইডের জন্য ৩ হাজার টাকা করে বাধ্যতামূলক পরিশোধ করতে হয়েছে। হাবের পক্ষ থেকে এ তিন হাজার টাকার বিনিময়ে একজন গাইডের জন্য মাত্র ৬০ টাকা মূল্যের একটি আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়।
শুধু তা-ই নয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে হাব সরকারি সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খাতেও অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বেশ কিছু এজেন্সির কাছ থেকে সরকারি চার্জ বাবদ ৮০০ টাকা, আপত্কালীন ২০০ টাকা, ট্রেনিং ফি বাবদ ৩০০ টাকা জমা নেয়া হয়েছে। অথচ সরকারি চার্জ ও ট্রেনিং ফি বাবদ ৫০০ টাকা, আপত্কালীন ১০০ টাকা জমা নেয়ার কথা। কিন্তু এজেন্সিগুলোকে সরকারি ফি’র কথা বলে হাব প্রতি হাজীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নিয়েছে।
জানা গেছে, হাজীদের জন্য ধর্মমন্ত্রণালয় নির্ধারিত বিভিন্ন খাতের এই নির্দিষ্ট টাকা সরকারি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করার কথা থাকলেও সেই সরকারি টাকা এবং হাবের পৃথক চাঁদার টাকা একসঙ্গে কয়েকটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বেশ কয়েকটি হজ এজেন্সির কাছ থেকে ফকিরাপুল সোনালী ব্যাংকের হিসাব নং- ৩৩০০৬৩৯৭ এর মাধ্যমে প্রতি হাজীর জন্য সরকারি চার্জ— আপত্কালীন ফান্ড, ট্রেনিং ফি এবং হাবের ব্যাগ বাবদ ১৭০০ টাকাসহ মোট ৩১০০ টাকা একসঙ্গে জমা নেয়া হয়। অথচ হাবের টাকা কিংবা সরকারি ফির টাকা একই ব্যাংকে লেনদেন হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো, সরকারি টাকা অন্য কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার সুযোগ নেই। হাবের কাছ থেকেও কোনো হাজীর টাকা নেয়ার নিয়ম নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারি ফি এবং হাবের বিভিন্ন ফির টাকা একসঙ্গে জমা হলো কীভাবে। এ ব্যাপারে হাবের কর্মচারী মাকসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওই অ্যাকাউন্টে সরকারি ও হাবের টাকা জমা হয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমেই যার যে টাকা তা ভাগাভাগি হয়েছে।’
সূত্র জানায়, এবার সৌদি আরবের নতুন নিয়মের কারণে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা পাঠানো, ভিসা প্রসেস, বাাড়ি ভাড়াসহ বড় ধরনের সমস্যায় পড়লেও হাব হাজীদের জন্য কোনো কিছুই করতে পারেনি। বরং ১৫ সদস্যের একটি বিশাল বহর নিয়ে প্রায় ১৫ দিন সৌদি আরব অবস্থান করে সংগঠনের বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে তারা। যা প্রতিবছর হাজীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে আদায় করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, হজ মৌসুমকে ঘিরে সেবা দেয়ার নাম করে হাজীদের নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্যে মেতে ওঠে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন (হাব)। প্রতিবছর হাজীদের জিম্মি করে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও ধর্ম মন্ত্রণালয় রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এমন ভূমিকার কারণে সংগঠনটির অন্যায় আবদার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এর ন্যূনতম প্রতিবাদও করতে পারেন না হাজী ও সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সিগুলো। হজ এবং ওমরা নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে হাবের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বলে জানা গেছে।