নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পুরো পরিকল্পনায় ছিলেন র্যাব-১১’র তিন কর্মকর্তা। তারা হলেন আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তথা ‘বস’। মূলত তাদের নির্দেশ পালন করতে গিয়েই আজ আমরা সাত খুনের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছি। শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্যই আমরা সাতজনকে অপহরণ ও পরে হত্যার কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম।
র্যাবের স্থানীয় অফিসারদের নির্দেশে অপহরণ থেকে শুরু করে সাতজনকে অজ্ঞান করে গাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে নেয়া, সাতজনকে হত্যার পর কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে লাশ লোড করে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিয়ে ফেলা— পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ততা ছিল বাধ্যবাধকতার কারণে।’
বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমের আদালতে সাত খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত র্যাব-১১ এর ৫ সদস্যের রিমান্ড শুনানির সময় তারা আদালতে এসব কথা বলেন। ওই সময়ে র্যাবের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার বারবার বলতে থাকেন— ‘আমরা শুধু বসদের হুকুম পালন করেছি’।
৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ মন্ডল। শুনানি শেষে ৫ জনকে ৮ দিন করে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। তারা হলেন র্যাব-১১ এর হাবিলদার এমদাদুল হক, আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক মো. হিরা মিয়া, বিল্লাল হোসেন এবং সিপাহী আবু তৈয়ব।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন জানান, মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে অনেকে স্বাক্ষীর জবানবন্দীতে হত্যাকান্ডে ভূমিকা রাখায় ওই ৫জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, এর আগে র্যাব-১১ এর সাবেক তিনজন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মাহমুদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।
এছাড়া হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো কয়েকজন আদালতে স্বাক্ষীর জবানবন্দী দেন। এ ঘটনায় স্থানীয় র্যাবের অনেক সদস্য সম্পৃক্ত ছিলেন। এ কারণে ডিবি পুলিশ র্যাব-১১তে কর্মরত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা এ হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত। আরো তথ্য উদঘাটনের জন্যই তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান জানান, সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলাতেই ৫জনকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত তদারক সংস্থা ডিবি। এর মধ্যে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ৫জনকে ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
এর আগে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় ১৭ জুন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় র্যাব-১১ এর চাকুরিচ্যুত অধিনায়ক ও অবসরে পাঠানো সেনা বাহিনীর লে. কর্ণেল তারেক সাঈদ। এর আগে আগে ৪ জুন র্যাব-১১ এর উপ অধিনায়ক ও অবসরে পাঠানো মেজর আরিফ হোসেন ও ৫জুন নৌ বাহিনীর কমান্ডার এম এম রানা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে খুনের দায় স্বীকার করেন।
আদালতের নির্দেশমত পুলিশ গত ১৬ মে দিনগত রাতে র্যাবের চাকুরীচ্যুত তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেন, ১৭ মে এম এম রানাকে গ্রেপ্তার করে। জবানবন্দীতে তিনজনই হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেন। উল্লেখ্য ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহূত হন।
পরদিন ২৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। ৩০ এপ্রিল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দু’টি করে বস্তায় বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
সাতজনকে অপহরণের পর ২৯ এপ্রিল রাতে সে সময়ের জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, র্যাব-১১ এর সিইও তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ, ক্রাইম প্রিভেনশনাল স্পেশাল কোম্পানীর কমান্ডার লে. কমান্ডার এমএম রানা, ফতুল্লা থানার ওসি আক্তার হোসেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল মতিনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাকে র্যাব থেকে চাকুরিচ্যূত করা হয়।