DMCA.com Protection Status
title="৭

এখনও রহস্যাবৃত মাওলানা ফারুকী হত্যাকান্ডঃ খুনিদের দ্রুত না ধরা হলে আন্দোলনের হুমকী।

08f8056dc94c8bd579b87a066681d013-39দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ সুপ্রিম কোর্টের জামে মসজিদের খতিব ও একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রসেনা। আগামীকাল শনিবারের মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করার সময়সীমা দিয়েছে তারা।অন্যথায় হরতাল সহ কঠোর কর্মসূচী দেবেন তারা।মাওলানা ফারুকী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ছিলেন।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মতিন) সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতা ফারুকী একাধিক ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। ফারুকী ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস ও ইসলামিক মিডিয়া জনকল্যাণ সংস্থা নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ছাড়াও মেঘনা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবসায়ী অংশীদার ছিলেন তিনি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি হজে লোক পাঠাতেন।

এদিকে ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পেছনে সম্ভাব্য চারটি কারণ সন্দেহ করেছে পুলিশ। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ফারুকীর ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে বিরোধিতা, পারিবারিক সমস্যা, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, হজে লোক পাঠানো নিয়ে বিরোধিতার জের ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে মামলার তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, ফারুকী ব্যক্তিগত জীবনে তিন বিয়ে করেছেন। এ ছাড়া তিনি একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরও মালিক। ধর্মীয় একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে ধর্ম প্রচারণা চালাতেন। এ ছাড়া প্রতিবছর তিনি হজে লোক পাঠাতেন। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। তবে তাঁর স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা দাবি করেন, তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শের প্রচার-প্রচারণা ও মাজারবিরোধী উগ্র গোষ্ঠীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার প্রতিবাদে গতকাল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কর্মীরা বিক্ষোভ করেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মদুনাঘাটে সড়ক আবরোধ করেন তাঁরা। গত বুধবার রাত আটটার দিকে দুর্বৃত্তরা পূর্ব রাজাবাজারের দোতলার ভাড়া বাসায় ঢুকে স্ত্রী ও স্বজনদের আটকে রেখে তাঁদের সামনে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে। বুধবার দিবাগত রাত সোয়া দুইটার দিকে ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ফারুকীকে খুন করে বাসা থেকে ছয় লাখ তিন হাজার টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। শেরেবাংলা নগর থানার পাশাপাশি মামলাটি ছায়া তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাব।

মামলা: মামলার বিবরণে বলা হয়, বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে পূর্ব রাজাবাজারে ফারুকীর বাসায় কলবেল বাজিয়ে দুই ব্যক্তি হজে যাওয়ার জন্য কথা বলতে এসেছে বলে জানায়। দরজা খুলে তাদের বসার ঘরে বসানো হয়। এ সময় তারা ফারুকীকে বলে, তাদের বড় ভাইয়েরা হজে যাওয়ার জন্য এসে কথা বলবে। যানজটে আটকে আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসবে। এর ২০ মিনিট পর ছয়-সাতজন লোক ঢোকে। একপর্যায়ে ফারুকী তাঁর ভাগনে মারুফ হাসানকে একটি চেয়ার আনতে বলেন। চেয়ার আনার পর মারুফ দেখতে পান, ওই ব্যক্তিরা ফারুকীর মাথায় পিস্তল ও চাপাতি ধরে আছে। এ সময় তারা মারুফের দুই হাত ও মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তারা ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা ইসলামের ঘরে ঢুকে তাঁকে, তাঁর মা, গৃহকর্মী ও ফারুকীর দুই নারী ভক্তকে বেঁধে ফেলে। রাত আটটার পর লুবনা কোনোভাবে বাঁধন খুলে এসে দেখেন ফারুকীর গলা কাটা, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। লুবনা চিৎকার দিলে আসামিরা বাসা থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকাসহ ছয় লাখ ৩০ হাজার টাকার গয়না ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী নিয়ে যায়। আসামিদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তাদের পরনে ফুলপ্যান্ট, শার্ট বা গেঞ্জি ছিল।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, খুনিদের শনাক্ত করতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। বুধবার রাতে দুর্বৃত্তরা ফারুকীর বাসায় অবস্থানকালে ময়মনসিংহ থেকে মাওলানা শফিকউল্লাহসহ তিন ব্যক্তি ডিসেম্বরে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠেয় ওয়াজ মাহফিলের চুক্তি করতে এসেছিলেন। ঘটনার বিষয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

বুধবার রাতে ফারুকীর মরদেহের সুরতহাল তৈরি শেষে তা ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে তাঁর লাশ বাসার সামনে নেওয়া হয়। ফারুকী পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদেরও খতিব ছিলেন। বাদ মাগরিব ওই মসজিদের সামনে তাঁর জানাজা হয়।

স্বজনেরা জানান, চট্টগ্রামে তাঁর ভক্তকুল বেশি। আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের জামায়াতুল ফালাহ মসজিদের সামনে তাঁর দ্বিতীয় দফা জানাজা হবে। এরপর লাশ ঢাকায় এনে স্থান নির্ধারণ করে দাফন করা হবে।



ফারুকীর বাড়িতে: গতকাল সকালে পূর্ব রাজাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, ফারুকীর সংগঠনের নেতা-কর্মী ও স্বজনদের ভিড়। বাড়ির বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ফারুকীর স্ত্রী লুবনা ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, দুর্বৃত্তরা বসার ঘরে ঢুকলেও তাঁর ঘরে গিয়ে বলে, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে তারা এ বাসায় ঢুকেছে। পুলিশকে এ বিষয়ে যেন কিছু না বলা হয়। তাদের হাতে তিনটি পিস্তল ও তিনটি চাপাতি ছিল। এদের একজনের মাথায় টুপি পরা ছিল। তার বয়স ২২ বছর হবে। একপর্যায়ে তারা তাঁদের বেঁধে ফেলে তাঁর স্বামীর কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। ফারুকী চেকের মাধ্যমে টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা শোনেনি।



লুবনা বলেন, এবারও তাঁর স্বামীর মাধ্যমে ৫০ জনের হজে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর স্বামী প্রায়ই হুমকির কথা বলতেন। আহলে সুন্নাতের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এ হুমকি আসছে বলে তিনি তাঁকে বলতেন। শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী ও মাজার জিয়ারতের পক্ষে কথা বলায় উগ্রপন্থী একটি গ্রুপ ক্ষুব্ধ ছিল।

আহলে সুন্নাতের কর্মী মুফতি নজরুল ইসলাম দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, ফারুকী গত সোমবার টঙ্গীতে ওয়াজ মাহফিলে বলেছিলেন, ইসলামের প্রচার চালাতে গিয়ে হুমকির শিকার হচ্ছেন। আরেক টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার আরকানউল্লাহ হারুনী ও তারেক মনোয়ার তাঁর বিরুদ্ধে টেলিভিশনে প্রচারণা চালাচ্ছেন। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার জানান, হারুনী ও তারেককে সন্দেহভাজন তালিকায় রাখা হয়েছে। আহলে সুন্নাতের কর্মী মুফতি নজরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের জন্য আহলে হাদিস, হিযবুত তাহরীর ও জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেন।

বিক্ষোভ: গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ফারুকী হত্যার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেছে আহলে সুন্নত ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। আধা ঘণ্টা ধরে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি চলে। তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদীতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন হয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ব্যানারে। তারা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে এবং গাছ ফেলে অবরোধ তৈরি করে। গাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাচ ভাঙচুর করে।

নিন্দা: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া,ফারুকী হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান ও হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী এ প্রতিবাদ জানান। এ ছাড়া আরও বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), ছুন্নী আন্দোলন বাংলাদেশ।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!