দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরইমধ্যে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এসব এলাকায় শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে। আশ্রয় হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে এসব গ্রামের হাজারও মানুষ। ফলে এসব এলাকায় দ্রুতই রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়াসহ শত শত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এদিকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীর রহদহ বাঁধের ৫০০ মিটার অংশ প্রবল পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে। এছাড়া পানিবন্দী মানুষ অসহায় অবস্থায় রয়েছে। কাছাকাছি কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে তারা। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তাদের শুকনো খাবার বিতরণ করা হলেও পানীয় জলের সংকটে রয়েছে।
বগুড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, বাঁধটি গত বছর নির্মাণ করা হয়। বাঁধের ৫০০ মিটার অংশ ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, রাত দুইটার দিকে বাঁধ ভেঙে ৩০ থেকে ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া বৃহস্পতিবার বাঙ্গালি ও ইছামতী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়। ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের চার হাজার পরিবার নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
এদিকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় বন্যানিয়ন্ত্রণ রিং বাঁধের ৩০ মিটার এলাকা পানির চাপে ধসে গেছে। শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে ওই এলাকার চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জ-কাজীপুর-সোনামুখী সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত হওয়া গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘাই, মেঘাই পশ্চিমপাড়া, বড়ইতলী ও কুনকুনিয়া। এখনো ওই বাঁধের ধসে পড়া অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে।
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, যমুনা নদীর প্রবল পানির চাপের কারণেই বাঁধের ৩০ মিটার এলাকা ধসে গেছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ যমুনায় পানির চাপ অনেক বেশি। ধসে যাওয়া অংশে বালুর বস্তা দিয়ে পানি আটকানর চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পানির নিচে রয়েছে কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম্। পানিবন্দি কয়েকলাখ মানুষ খাবার, বাসস্থান ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল .হারানোর আশঙ্কায় হাহাকার করছে কৃষকরা। বন্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য শুক্রবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক জরুরি সভাও হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, শুক্রবার ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বিপদ সীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের সংবাদ মাধ্যমকে জানান, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদ সীমার ৪৯ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন চর-দ্বীপচর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জয়নাল আবেদিন জিল্লুর জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। দুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক প্রতীপ কুমার মন্ডল জানান, জেলার নয় উপজেলায় প্রায় দুই লাখ কৃষকের ৩২ হাজার হেক্টর সবজি ও ফসলি জমি এখন বন্যার পানির নীচে।
জেলা ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান জানান, নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫৬টি ইউনিয়নের ৪১৬ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। কাঁচা রাস্তা ৮৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, পাকা রাস্তা এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য প্রবল বর্ষণ ও উজানের ঢলের কারনে এ মাসের ১২ তারিখ থেকে উত্তরের এ জেলায় বন্যা দেখা দেয়।
অপরদিকে উজান থেকে নেমে আসা পানি ও বৃষ্টিতে মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পদ্মার তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে নদী ভাঙন।
শুক্রবার সকাল ৯টার রেকর্ড অনুযায়ী জেলার ভাগ্যকূল পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল। পানি বাড়ার কারণে জেলার নতুন নতুন অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কামারখাড়ায় পদ্মার ভাঙন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের মুখে কামারখাড়া বড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকারি হিসেবে ৪৯টি পরিবারের বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ৮২৩টি পরিবারের বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন প্লাবিত এলাকায়ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হবে বলে জানান সাইফুল হাসান বাদল। আগে থেকেই প্লাবিত শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকূল ও বাঘরা, লৌহজংয়ের মেদিনীমণ্ডল, হলদিয়া, কনকসার, কুমারভোগ সিরাজদিখানের চিত্রকোট, টঙ্গীবাড়ির পাঁচগাঁও, হাসাইলবানারী, সদর উপজেলার শিলইসহ বিস্তীর্ণ এলাকার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
জামালপুর:
পাহাড়ী ঢলে ও যমুনার পানি বেড়ে জামালপুরে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ৩৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ও জিঞ্জিরামসহ শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপদ সীমার নীচে রয়েছে।
এছাড়া ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ ও সদর উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত দু্ই লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। ইসলামপুরের ১২টি ইউনিয়নই এখন বন্যাকবলিত। উপজেলার অন্তত ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রোপা, আমন ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আর মাদারগঞ্জের অন্তত ৫০/৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। মেলান্দহ উপজেলার ২৫/৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির তীব্র স্রোতে মেলান্দহ-মাহমুদ সড়কের কজওয়ে (ড্রাইভাশন) ডুবে ভেঙ্গে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এই উপজেলায় এখনো কোন ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি ।
বন্যায় জামালপুর জেলার ২০ হাজার ৪৪৬ হেক্টর জমির রোপা, আমন, আউশ ও সবজির ক্ষেত ডুবে গেছে।
গাইবান্ধা:
গাইবান্ধায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটেছে। প্লাবিত হয়েছে কৃষি জমিসহ নতুন নতুন এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় ঘাঘট নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁইছু্ইঁ করছে।
গত দুদিনে পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার চারটি উপজেলা ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদরে নুতন করে এক হাজার ১৫৮ হেক্টর আবাদী জমি তলিয়ে গেছে। ফলে বর্তমানে নিমজ্জিত আবাদি জমির পরিমাণ তিন হাজার ৭৯ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।
দুদিনে সাঘাটার হলদিয়া চিনিরপটল পালপাড়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে চিনিরপটল, চকপাড়া, পবনতাইড়, থৈকরপাড়া, গোবিন্দি, বাঁশহাটা, সাথালিয়া, হলদিয়াসহ ১০টি গ্রাম নতুন করে বন্যা কবলিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানির তীব্র স্রোতের কারণে উপজেলার সিংড়িয়া এলাকায় নদী ভাঙনের ব্যাপকতা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫টি পরিবারের বাড়ি-ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন কবলিত নদী থেকে ১৫ ফুট দুরে থাকায় সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
গাইবান্ধা সদরে ঘাঘট নদীর পানির চাপে শহর রক্ষা বাঁধের দশানি এলাকায় একশ’ ফুট রয়েছে হুমকিতে। বাঁশের পাইলিং ও বালুর বস্তা ফেলে মেরামতের চেষ্টা চললেও এলাকাবাসীর মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।
সরকারি হিসাব মতে, গত তিনদিনে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ির সংখ্যা তিন হাজার ৬১০টি বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৫৪টি। এরমধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাত হাজার ২৩৩ এবং আংশিক আট হাজার ৮২১টি। এ পর্যন্ত জেলার চার উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের ২৪ হাজার ৯৪টি পরিবারের এক লাখ ১৬ হাজার ৫০৩ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।