খুব সহজেই বাড়িয়ে নিন আপনার বিটকয়েনের আয়’, ‘চলুন জানি বিটকয়েন কি? কিভাবে আয় করবো এনড্রয়েড ও পিসি দিয়ে!’ এমন গালভরা ব্লগপোস্ট আর অনলাইন প্রচার সহজেই চোখে পড়তে পারে আপনার। বিনাপরিশ্রমে ‘ডলার’ আয়ের এই সুযোগে আকৃষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণরা।
অনলাইনে প্রায় বছর খানেক ধরে বিটকয়েনের ব্যাবসা চললেও সম্প্রতি তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে এবং ব্যাংক গনমাধ্যমে এর সমূহ ঝুকির বিষয়ে জনগনকে সতর্ক করে দেন।
সহজ কথায়, বিটকয়েন হচ্ছে কথিত ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি। ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি হচ্ছে এমন টাকা যা হাতে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। বাংলাদেশী টাকা দিয়ে বিটকয়েনের ওয়েব সাইট থেকে আপনি এই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি কিনতে পারবেন। এরপর এই কারেন্সি দিয়ে কেনাকাটা করতে পারবেন ওয়েব সাইটে। এই টাকা থাকে কেবল আপনার কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভে কিংবা বিটকয়েনের ওয়েবসাইটে তৈরী আপনার একাউন্টে।
উপরের বিবরণে বিটকয়েন ব্যবসায়ের ফটকাবাজির দিকটি থেকে যাচ্ছে অপ্রকাশ্যে। ধরুণ, আপনার ১০টি বিটকয়েন আছে। তাহলে চলতি হিসেবে বাংলাদেশী টাকায় আপনার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এখন, বিটকয়েনের দাম কখনই একরকম থাকে না। ফটকাবাজরা প্রতিদিনই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে বিটকয়েনের দাম। তাই, কয়েকদিন পরেই দেখা যাবে, আপনার বিটকয়েনগুলোর মূল্য বেড়ে গেছে দেড় থেকে দুইগুণ। তাহলে, কিছুই না করে আপনার আয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল কয়েকগুণ। এইভাবে, ঘরে বসে আয় করার জন্য প্রলুব্ধ হচ্ছেন তরুণরা।
কেবল বাংলাদেশের তরুণরাই নয়, ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার অনেক তরুণরাও এই ফটকাবাজির ব্যবসায়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে আর্থিক ক্ষতির শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। এদেরই একজন হচ্ছেন উইল ফিলিপস।
২০১৩ সালের শুরুতে একটি বিটকয়েনের মূল্য ছিল ৭ পাউন্ড। কিন্তু ওই বছরের নভেম্বরে এসে একটি বিটকয়েনের দাম দাঁড়ায় ৭৫০ পাউন্ড। এই হিসেবে এক বছরের মধ্যেই বিটকয়েনের দাম বেড়ে যায় ১০০গুণ। অর্থাৎ কেউ বিটকয়েন কিনে রেখে দিলে, যে কেউ এক বছরে ১০০গুণ লাভ করতে পারতেন।
এই ধরণের লাভের হিসাব দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন উইল ফিলিপস। তিনি ৮০০ পাউন্ড খরচ করে বিটকয়েন কেনেন। কেনার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার কেনা বিটকয়েনগুলোর দাম বেড়ে যায় অনেকগুণ। এবার তিনি বিটকয়েনগুলো বিক্রয় করে লাভ তুলতে চেয়েছিলেন নিজের পকেটে। কিন্তু তখনই দেখা দিল বিপত্তি। তিনি ই-কমার্স সাইট ই-বে’র মাধ্যমে বিক্রয় করার চেষ্টা শুরু করেন। এরপরই তার একাউন্টটি হ্যাক হয়ে যায়। আর তিনি নিজের সব অর্থ খুইয়ে ফেলেন। উইল ফিলিপসের এইভাবে প্রতারিত হওয়ার গল্প বিরল কিছু নয়।
বিটকয়েন বেচা-কেনার সবচেয়ে ব্যবহৃত ওয়েবসাইট ছিল এমটিগক্স। এই ওয়েবসাইটটি টোকিওভিত্তিক। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ উধাও হয়ে যায় ওয়েবসাইটটি। ফলে শূন্যে মিলিয়ে যায় ৭৫,০০০ বিটকয়েন। ফলে বিটকয়েনের ক্রেতা-বিক্রেতারা কয়েক মিলিয়ন ডলার ক্ষতির শিকার হন।
এইভাবে, একদিকে বিটকয়েনের দাম বাড়িয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে, অন্যদিকে ওয়েবসাইট হ্যাকিং, একাউন্ট উধাও করে মানুষকে পথে বসানো হচ্ছে।
রেমিট্যান্স খাত থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থিক লেনদেনকে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করেছে অনলাইনে আর্থিক ফটকাবাজির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিটকয়েন। এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরেও মানুষে মানুষে আর্থিক লেনদেনকে নিজেদের ফটকাবাজি ব্যবসায়ের আওতায় আনতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করেছে অনলাইন ফটকাবাজির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিটকয়েন। বাংলাদেশে এই ফটকাবাজির ব্যবসায়ের প্রধান উদ্যোক্তা হচ্ছেন সজীব। তিনি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা ও সঙ্গীত তারকা হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বিটকয়েন বাংলাদেশের নিজস্ব ওয়েবসাইটে সজীবের ঠিকুজীতে বলা হয়েছে, তিনি একজন ইন্টারনেট মার্কেটিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এছাড়াও উদ্যোক্তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন শাহরিয়ার হাসান পৃথিবী নামের একজন। প্রোফাইল পরিচয় অনুসারে, তিনি জীবনের শুরু থেকেই তথ্য-প্রযুক্তি প্রেমিক। এছাড়া একটি এফএম রেডিওর সাথেও সম্পৃক্ত আছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও জড়িত আছেন মিজানুর রহমান নামের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
এরই মধ্যে অনলাইন ভিত্তিক আর্থিক ফটকাবাজির ব্যবসায় বিটকনের মাধ্যমে লেনদেন না করার জন্য সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি এড়াতে বিটকয়েনের মত ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায় লেনদেন বা এসব লেনদেনে সহায়তা ও প্রচার থেকে বিরত থাকতে সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিটকয়েন বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কতিপয় সংবাদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গোচরীভূত হয়েছে। বিটকয়েন বিবিধ বিনিময় প্লাটফর্মে কেনা বেচা হচ্ছে। অথচ বিটকয়েন কোনো দেশের ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। বিটকয়েন বা বিটকয়েনের মত অন্য কোনো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন বহির্ভূত এসব লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।