গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল শুরুর আগে আগামী চার মাসকে আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ সময় বলে বিবেচনা করছে বিএনপি। চাপের মুখে আগাম নির্বাচনে আনার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে যা যা করা দরকার, দলটি তা আসছে শীত ও শুষ্ক মৌসুমের মধ্যে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই করতে চাইছে।তবে আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখবে বিএনপি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের ধীরে ধীরে প্রস্তুত হতে বলছেন। তবে মাঠে নামার সবুজ সংকেত এখনো দেননি। আন্দোলনকে ধাপে ধাপে তুঙ্গে নেওয়ার সম্ভাব্য কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে জনসভা ও রোডমার্চ এবং হরতাল কর্মসূচি ছাড়াও এবার সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দেওয়ার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
নীতিনির্ধারক বলে পরিচিত বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী মার্চ মাস পার করতে পারলেই সরকার পূর্ণ মেয়াদের জন্য টিকে যেতে পারে। আবার টিকতে পারলে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য সরকারের হাতে কিছু কার্ড রয়েছে। তারা বলবে জনগণ খুশি আছে; নির্বাচনের দরকার কী? তারা ধর্মনিরপেক্ষতা, জঙ্গিবাদ দমন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ নানা ইস্যু তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দেশগুলোকে নিরপেক্ষ রাখার বা পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তাই এসব সুযোগ সরকারকে দেওয়া হবে না। যা করার মার্চের মধ্যেই করতে হবে, বলেন ওই নেতা।ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দিতে পারে বিএনপি।
এছাড়া এই চার মাসের মধ্যেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার মামলার গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হতে পারে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থানও এ সময়ের মধ্যে অনেকটাই স্পষ্ট হবে বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে সরকারের চূড়ান্ত অবস্থানও এ সময়ের মধ্যে স্পষ্ট হবে। সর্বোপরি, অস্তিত্বের সংকটে পড়া বিএনপি শেষ পর্যন্ত কতদূর যেতে পারবে তা অনেকটাই নির্ধারিত হবে এই চার মাসে।
মার্চের পর গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল শুরু হবে। এরপর প্রায় আট মাস আন্দোলনের জন্য অনুকূল সময় নয়। তাই ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনের সঙ্গে সংগতি রেখে আন্দোলনের ছক তৈরি করছে বিএনপি। ওই দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পাশাপাশি সংগঠনের কোন নেতাকে দিয়ে কী কাজ হবে তা আগাম বিবেচনায় নিয়ে সংগঠন পুনর্গঠনের কাজও চলছে। যাকে যে পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন, খালেদা জিয়া একান্তে ডেকে তাও দিচ্ছেন।
দলের বড় একটি অঙ্গসংগঠনের সভাপতি সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা জানিয়ে বলেন, তিনি ছাড়াও মধ্যম পর্যায়ের অনেক নেতাকে বিএনপি চেয়ারপারসন প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সময় হলে নির্দেশ দেবেন।
দলটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা আমাদের জানিয়েছেন, গত ২৯ ডিসেম্বরের ‘গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা’ কর্মসূচিসহ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ববর্তী আন্দোলন যেসব কারণে ব্যর্থ হয়েছে তা খতিয়ে দেখে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কর্মকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনা হবে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সরকারের গ্রেপ্তার চেষ্টা কী করে এড়ানো যায়, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি। এ ছাড়া খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে ওই সময় করণীয় নির্ধারণ, বিশেষ করে দল পরিচালনার বিষয়টি আগাম পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
দলটির বড় একটি অংশ মনে করে, গুলশানের বাসভবনের সামনে বালির ট্রাক ফেলে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখার সরকারি কৌশলের কারণেই মূলত ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভবিষ্যৎ আন্দোলন ভণ্ডুলের ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী পাল্টা কৌশলও এবার বিবেচনায় নেবে বিএনপি।
দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী চার-পাঁচ মাসে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের পরিকল্পনা থাকলেও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, আন্দোলনের জন্য কোনো দিনক্ষণ থাকে না। তবে বিএনপির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তা ছাড়া জনগণ যেভাবে আন্দোলন চাইছে তাতে সাড়া দিতে বিএনপিকে মাঠে নামতেই হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম এগুলো আমাদের বিবেচনায় আছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আন্দোলন শুরু হবে।’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আন্দোলন শুরু হবে এটা জানি, কিন্তু কখন শেষ হবে এটা জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের লোকজন যেভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছে তাতে মনে হয়, ওদের অবস্থা অত ভালো না। আমার মনে হয়, চার মাস লাগবে না; দেড় মাস আন্দোলন করলেই ওরা পালানোর পথ পাবে না।’
বিএনপির যুুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাজাহান মনে করেন, বর্ষা শুরুর আগের চার মাসে জনগণের শক্তিকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনে গেলে অবশ্যই সফল হবে। তিনি বলেন, গুম-খুন, জেল-জুলুমসহ সব অপকৌশলের আশ্রয়ই সরকার নেবে। কিন্তু মূল ফ্যাক্টর জনগন।