DMCA.com Protection Status
title="৭

আবার সরকারী জমি হরিলুটের পায়তারা

r2-300x203আওয়ামী লীগের একাধিক সাংসদের সন্তান-ভাইসহ ৩৪ জন এবার রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি প্লট পাচ্ছেন। এই তালিকায় আমলা ছাড়াও পূর্তমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী এলাকার লোকজনও রয়েছেন। রাজউকের উত্তরা, পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় এসব প্লট দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন প্রায় চূড়ান্ত।



অথচ গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ জুন বলেছিলেন, বিশেষ কোটায় আর প্লট দেওয়া হবে না। এ ছাড়া আগে দেওয়া প্লট পরিবর্তন বা সম্প্রসারণও করা হবে না। এখন তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই অমান্য করলেন।

সংরক্ষিত কোটায় ৩৪ জনের নামে প্লট বরাদ্দের জন্য রাজউকে তালিকা পাঠানোর পর গত আগস্ট মাসে রাজউক বোর্ডের অষ্টম সভায় এটি অনুমোদন হয়। তবে বিষয়টি যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য সবাইকে এখনই বরাদ্দপত্র দেওয়া হচ্ছে না।

মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকা ছাড়াও রাজউকের নথি ও দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তালিকা অনুসারে পূর্ত মন্ত্রণালয়েরই আটজন বড় কর্মকর্তা প্লট পাচ্ছেন।

রাজউকের বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, সংরক্ষিত কোটায় প্লট দেওয়া হয় ১৩-এ ধারামতে। এই ধারায় বলা আছে, সাংসদ, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, যাঁরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রেখেছেন, তাঁদের প্লট দেওয়া যায়। তবে রাজউক এলাকায় যাঁদের নিজস্ব প্লট বা ফ্ল্যাট রয়েছে, তাঁরা প্লট পাবেন না। পূর্বাচল প্রকল্পে অবশ্য রাজউক এলাকায় নিজস্ব প্লট বা ফ্ল্যাট থাকলেও উপযুক্ত হলে তিনি প্লট পেতে পারেন। কিন্তু এই ৩৪ জনের বেশির ভাগই ১৩-এ ধারা অনুযায়ী প্লট পাওয়ার যোগ্য নন। কারণ, এঁদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখার কোনো সুযোগ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে মান্নান সাহেব (সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান) সামান্য কিছু প্লট রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলো থেকে কিছু প্লট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে।’

রাজউকের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এই সরকারের গত আমলে যোগ্য ও অযোগ্য অনেককেই প্লট দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারের শেষ সময়ে প্রায় ৬০০ জনকে প্লট দেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এগুলো নিয়ে তদন্ত করছে। সংসদীয় কমিটিও আলাদা তদন্ত করছে। দলীয় ও পছন্দের লোকদের নামে-বেনামে প্লট দেওয়ার অভিযোগে দুদক সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। এত কিছুর পরও বর্তমান পূর্তমন্ত্রী ৩৪ জনকে প্লট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। না হলে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়। নিজের চাকরিজীবনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে তিনি পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন ডিআইটির প্লট দিয়েছিলেন সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে। যে কারণে বরাদ্দ নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ ওঠেনি।

যাঁরা প্লট পাচ্ছেন: তালিকা অনুসারে আওয়ামী লীগের সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে সেরনিয়াবাত আশিক আবদুল্লাহ ও সেরনিয়াবাত মঈন আবদুল্লাহকে উত্তরায় তিন কাঠা করে প্লট দেওয়া হচ্ছে। পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে সাড়ে সাত কাঠার প্লট দেওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান (মারুফ) এবং শেখ নাসেরের ছেলে ও শেখ হেলালউদ্দিনের ছোট ভাই শেখ বেলালউদ্দিনকে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ সাকীব ওরফে বাদশাকে উত্তরায় তিন কাঠা, নড়াইল জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান ও সাবেক সাংসদ শরীফ খসরুজ্জামানকে উত্তরায় পাঁচ কাঠা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সন্তানদেরও প্লট দেওয়া হচ্ছে।

উত্তরায় প্লটের সংকট রয়েছে বলে প্রচার করা হলেও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের আট কর্মকর্তার সবাইকেই উত্তরায় প্লট দেওয়া হচ্ছে। এই মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা চলতি বছরে বদলি হয়ে গেছেন। আগে তাঁরা প্লট পেয়েছেন। এবার যাঁরা প্লট পাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই

কয়েক মাস আগে এই মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে পাঁচ কাঠা আয়তনের প্লট দেওয়া হচ্ছে তিনজনকে। এঁরা হচ্ছেন যুগ্ম সচিব এস এম আরিফ-উর-রহমান, যুগ্ম সচিব মো. আহসান হাবীব তালুকদার, মন্ত্রীর একান্ত সচিব ফয়েজ আহাম্মদ। তিন কাঠার প্লট দেওয়া হচ্ছে উপসচিব জিল্লুর রহীম শাহরিয়ার, সাবিহা পারভীন ও সায়লা ফারজানা, পূর্তসচিবের একান্ত সচিব খন্দকার মনোয়ার মোর্শেদ এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী শ্যামলী নবীকে। গত ১৭ জুলাই শ্যামলী নবীর স্বাক্ষরেই মন্ত্রণালয়ের তালিকার চিঠি রাজউকে পাঠানো হয়।

আরও যাঁদের নাম তালিকায় রয়েছে, তাঁদের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ টি এম মুর্তজা রেজা চৌধুরী ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠা, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দত্ত পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে সাড়ে সাত কাঠা, পূর্তমন্ত্রীর নিজ এলাকার লোক (চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মহাজন হাট, জোরারগঞ্জ) মো. মোসাদ্দেক হোসেন, মো. মীর আলম ও নূরুল হুদা (ডোমখালী, মিরসরাই), জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীকে (দক্ষিণ মুরাদপুর) উত্তরায় তিন কাঠা করে, নিজ জেলার হালিশহরের আবুল বশরকে পূর্বাচলে পাঁচ কাঠা দেওয়া হচ্ছে।

অন্য যাঁরা প্লট নিচ্ছেন, তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে রাজউকের সম্পত্তি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, এঁদের প্লট পাওয়ার পেছনে ক্ষমতাশালীদের প্রভাব রয়েছে। এঁদের মধ্যে ঢাকার নুরের চালা-বারিধারার আফিয়া খানম চৌধুরীকে (স্বামী মরহুম গাউস খান) পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠা, উত্তরায় তিন কাঠার প্লট দেওয়া হচ্ছে মনোরঞ্জন ঘোষাল (সাতক্ষীরার তালা), আজহারুল ইসলাম (২৫, শান্তিনগর), গাজী আবু সাইদ (৩০/২ পাঁচ ভাই ঘাট লেন, সূত্রাপুর), কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জের ফরিদা আক্তার কাউসারকে। এ ছাড়া ব্যাংক এম আর নম্বর উল্লেখ করে এস এম মুস্তফা রশীদকে ও আবছার উদ্দিন আহম্মদ খানকে উত্তরায় পাঁচ কাঠা করে, নিজাম উদ্দিন চৌধুরীকে ঝিলমিলে পাঁচ কাঠার প্লট দেওয়া হচ্ছে।

পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, শেখ মারুফ, শেখ বেলাল, হাসানাত আবদুল্লার ছেলে—এঁরা সবাই শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে প্লট পেতেই পারেন। তাঁদের কি অবদান নেই, তাঁরা কি প্লট পাওয়ার যোগ্য নন?

নিজ মন্ত্রণালয়ের আটজন আমলা এবং এলাকার লোকদের প্লট পাওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভালো করে যাচাই-বাছাই করছি। সবাই চূড়ান্তভাবে প্লট পেয়ে যাবেন, তা এখনই বলা ঠিক নয়। আমরা এমন কোনো কাজ করব না, যেগুলো প্রশ্নবোধক হবে।’

জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যাঁদের নাম এসেছে, আপাতত তাঁদের প্লট দেওয়া হচ্ছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে, আপাতত ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো নেই। এখনই বরাদ্দপত্র দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। তবে পুরোপুরি ঠেকা দেওয়া তো আমাদের সাধ্য না, মন্ত্রণালয় কী বলে দেখা যাক।’

এদিকে রাজউক সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে উত্তরাসহ অন্য প্রকল্পে সবাইকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। উত্তরায় কিছু ক্ষেত্রে একই প্লট দু-তিনজনের নামে বরাদ্দ হয়ে গেছে। প্লট কম বলে অনেককে প্লট নম্বরও দেওয়া যায়নি।

যাঁদের প্লট দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফোন করা ছাড়াও খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে কিন্তু সাড়া মেলেনি। শেখ ফজলুর রহমান ও শেখ বেলালউদ্দিনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!