হাসিনা সরকারকে বিদায় করে ঘরে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন ২০ দলীয় জোট নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার বিকেলে নীলফামারী জেলা স্কুল মাঠে আয়োজিত স্মরনকালের বৃহত্তম জনসভায় এ ঘোষণা দেন তিনি।
বেগম জিয়া বলেন, ‘এখন কিছু বলবো না। ৩০ তারিখে নাটোরে জনসভা আছে। আরও কিছুদিন জনগণের সঙ্গে দেখা করবো। আগামীতে সময়মতো আন্দোলনের ডাক দেব। তখন আপনারা আবার জেগে উঠবেন। সেই আন্দোলনে এই আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় করে আমরা ঘরে ফিরবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশে বাকশাল নয়, একদলীয় শাষন নয় বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবো। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন হবে, জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। আজকে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ। যারা দেশের জন্য, জনগনের জন্য কাজ করে তারা কখনও পরাজিত হবে না। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় আমাদের হবেই হবে।’
‘আমরা অনেক অন্যায় অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেছি। আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি, আরও রক্ত দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এ জনসভার আয়োজন করেছে ২০ দলীয় জোট। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আনিসুল আরেফিন চৌধুরী।
৫৭ মিনিটের বক্তব্যে খালেদা জিয়া আগামী আন্দোলন, সরকারের দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, গার্মেন্টস শিল্প, বিনিয়োগ, শ্রমবাজার, নির্বাচন কমিশন, দুদক, ধর্মনিরপেক্ষতা, মিথ্যা মামলা, র্যাব-পুলিশসহ দেশের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন।
এবার ঢাকায়ও আন্দোলন হবে
সারাদেশে আন্দোলন হলেও ঢাকায় আন্দোলন হয়নি স্বীকার করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আন্দোলনে ডাক দিয়েছিলাম। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আপনারা তা করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা আন্দোলন করে সব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা আন্দোলন করতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘এবার ঢাকাও আন্দোলন করবে, সারাদেশই করবে। কখন করবেন সময় মতো জানাবো। এখন নয়। যখন সময় আসবে ঠিক সেই সময় জানাবো। আপনারা আন্দোলন শুরু করবেন। অত্যাচারী খুনি সরকারকে বিদায় করবেন।’
নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে
বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন অথর্ব। এই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এদেরকে বাতিল করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। যারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে। পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সিভিল প্রশাসন ও পুলিশকে নিরপেক্ষ হতে হবে।’
‘দুর্নীতি সহায়ক’ কমিশন দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘দুর্নীতি সহায়ক’ কমিশন আখ্যা দিয়ে বেগম জিয়া বলেন, ‘দুর্নীতির জন্য সরকারের যেসব মন্ত্রীর-এমপিদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, দুদক এদের সকলকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এরা আগে কী ছিল, এখন দুর্নীতি করে কীরকম মোটাতাজা হয়েছে, এসবের কাগজ আমাদের কাছে আছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন নিজেই দুর্নীতি করছে। দুদক দুর্নীতি সহায় কমিশনে পরিণত হয়েছে। সরকারের আদেশে কাজ করছে। দুদকে সৎ সাহসী মানুষ দিতে হবে।’
র্যাব-পুলিশ
আবারো র্যাব বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার প্রতিনিয়ত জনগণের উপর অত্যাচার করছে। র্যাব গঠন করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্র লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করতে । রাজনৈতিকদের দমন গুম খুন করার জন্য র্যাব গঠন করা হয়নি। অথচ এই সরকার র্যাবকে রাজনীতিকদের দমনে ব্যবহার করছে। এরা
র্যাবকে নষ্ট করে ফেলেছে। র্যাব এখন টাকার বিনিময়ে গুম, খুন করছে। এখনো প্রতিনিয়ত লাশ ভাসতে দেখা যায়। তাই আমরা বলেছি র্যাবকে বাতিল করতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের জিয়াউল আহসনকে নিদের্শদাতাদের গ্রেপ্তার করলে সকল তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা জনগণের সেবক। অবৈধ সরকার গুম, খুন করছে তা চলতে পারে না। এসব বন্ধ করুন। আপনাদেরও মা-ভাই-বোন আছে। তাই সচেতন হোন। জনগণ আনেদালন করলে তা হবে শান্তিপূর্ণ। সে আন্দোলনে গুলি চালানোর দরকার হয় না। কথায় কথায় গুলি করার অধিকার জনগণ দেয়নি। বিদেশিরা আপনাদের গুলি, টিয়ার শেল দেয়া বন্ধ করতে চায়। সরকার দেশের সম্মান কোথায় নিয়ে গেছে।’
এখন পুলিশে চাকরি পেতে হলেও টাকা লাগে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সরকার সকল সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, ‘সরকার গার্মেন্ট শিল্প, পাট শিল্প, টেক্সটাইল শিল্প ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন ওষুধ শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের মান কমে যাওয়ায় এখন আর রপ্তানি হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকার ব্যাংকিং সেক্টরকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সরকার এই দেশকে দেউলিয়া করে দিতে চায়। জনগণ জানতে চায় সুইস ব্যাংকে কাদের টাকা। সুইস ব্যাংকেও এদের টাকা। কুইক রেন্টালের নামে হাজার
হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। নীলফামারীর জনগণ বিদ্যুৎ পায় না। ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জামালপুরের জনগণ বিদ্যুৎ পায় না। তাহলে বিদ্যুৎ যায় কোথায়।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারের সব মিথ্যা। মিথ্যার উপর ভর করে ওরা টিকে আছে। কিন্তু বেশি দিন টিকে থাকা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারের সাথে আজকে জনগণ নেই। দেশের জনগণ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আছে, থাকবে। সেজন্যই আমরা বলেছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন। আপনারা যদি নিজেদের জনপ্রিয় মনে করেন ভোট দেন। যদি ক্ষমতায় আসেন আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু চুরি করে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।’
নতুন নতুন আইন
‘অবৈধ সরকার নতুন নতুন আইন করছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘অবৈধ সরকার ক্ষমতায় বসে নতুন নতুন আইন করছে। এসব বাদ দেন। নির্বাচিত না হয়ে কোনো আইন পাশ করলে তা বৈধ হবে না। গণবিচ্ছিন্ন বলে এইসব করা হচ্ছে। বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করতে চায়। টকশোতে সরকারের সমালোচনা করা হয়। এ জন্য সেইসব বন্ধ করতে চায়। অনেককেই টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। খবরের কাগজ বন্ধ করে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা নতুন নয়। এর আগেও তারা এমনটা করেছিল। এখন আবার তারা একটু কায়দা-কানুন করে আবার আগের জায়গায় এসেছে।’
বিচারকদের অভিসংশন
খালেদা জিয়া বলেন, ‘সরকার বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। যাতে যাকে সাজা দিতে বলবে তা বিচারকদের শুনতে হয়, না হলে চাকরি থাকবে না। বিচারকদের হাত বেধে দিয়ে জনগণকে সুশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না ‘
কথায় কথায় মামলা
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এই দেশকে আজ তারা অকার্যকর রাষ্ট্র করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কথায় কথায় মামলা দিচ্ছে। হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করুন, ১৩টা মামলা ছিল- তা কি করে প্রত্যাহার করা হলো। আওয়ামী লীগের লোকজনের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এটা হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ হলে সব মাফ আর অন্য দল হলে একের পর এক মিথ্যা সাজানো মামলা। এই অবস্থা চলতে পারে না। আইন সকলের জন্য সমান। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না।’
আ.লীগের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমাদের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। মধ্য প্রাচ্যসহ অন্য দেশে লোকজন পাঠাতে পারি না আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। টাকা পাঠাতে পারে না। রেমিটেন্স কমে গেছে। দেশটা কী এভাবেই চলবে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। স্বৈরাচার মুক্ত করতে হলে এদের হঠাতে হবে। র্যার আর পুলিশকে রক্ষী বাহিনী বানাচ্ছে। এখনো প্রতিদিন লাশ পাওয়া যায়। এই অবস্থা জনগণ আর চায় না।’
বিদুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ালে প্রতিবাদ
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘বিদ্যুৎ- গ্যাসের দাম বাড়াবেন, কিন্তু মানুষের তো দেয়ার ক্ষমতা নেই। জনগণের কষ্ট হবে। যদি দাম বাড়ানো হয় তাহলে জনগন প্রতিবাদ করবে।’
আ.লীগ ধর্ম নিয়ে ‘ব্যবসা’ করে
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, ‘এরা বলে আমরা নাকি ধর্ম নিয়ে বক্তব্য দিয়ে বিশৃঙ্খলা করতে চাই। আমরা জানতে চাই, শাপলা চত্বরে কেন রাতে বাতি নিভিয়ে দিয়ে আলেমদের উপর আক্রমণ করে হত্যা করা হলো। তারা বলে এগুলো রক্ত নয়, রং। তাহলে কী আপনারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছেন না।’
তিনি বলেন, ‘তাদের এক মন্ত্রী হজ ও নবীকে (সা.) নিয়ে কটুক্তি করেছেন। তার প্রতিবাদে মিছিলে করেছে সেই মিছিলের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের বাড়িঘড় সম্পত্তি দখল করছে আওয়ামী লীগ। মন্দিরের অলঙ্কার চুরি করেছে, লুটপাট করেছে, মন্দির ভেঙেছে আওয়ামী লীগ। এদের ভয় দেখিয়ে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে আওয়ামী লীগ । বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ হত্যা করেছে। চন্দন সরকারকে র্যাব মেরেছে।’
সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে
‘ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করা হবে’ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘দেশে আজকে কোনো গণতান্ত্রীক সরকার নেই। আজকে যারা ক্ষমতায় আছে তারা অবৈধ। আপনারা ভোট না দেয়ায় এরা নির্বাচিত নয়। তাই তাদের দেশ পরিচালনার কোনো অধিকার নেই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে কোনদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। হবে না। তারা ক্ষমাতায় থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি।’
অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান তিনি।
খালেদার প্রতিশ্রুতি
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা দলীয়করণ নয় সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা প্রশাসনকে দলীয়করণ মুক্ত করবো। বিচারবিভাগকে স্বাধীন করবো। মিডিয়াকে নিরপেক্ষ করবো যাতে তারা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবো। যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন করবো। এরা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা নকল বন্ধ করেছিলাম। আর এখন এরা পাসের হাড় বাড়িয়ে সবাইকে জিপিএ ৫ দিচ্ছে। তাই সবার মধ্যে হতাশা এসেছে। ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। সরকার পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে।
জনসভায় বক্তব্য প্রদান শেষে নীলফামারী সার্কিটা হাউজে বিশ্রাম নেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এরআগে কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় নীলফামরী জেলা স্কুল মাঠে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত জনসভা শুরু হয়।
বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বগুড়া সার্কিট হাউজ থেকে নীলফামারীর উদ্দেশে রওনা হন। দুপুর আড়াইটায় নীলফামারী সার্কিট হাউজে পৌঁছান তিনি। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে জনসভায় যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির আসন গ্রহন করেন।