বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দরকষাকষির নতুন সুযোগ এনে দেবে চীনের নের্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প হিসেবে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন।
ক্রমবর্ধমান হারে উন্নতি করায় বাংলাদেশের মতো এশিয়ার দেশগুলোর অবকাঠাম খাতে বিনিয়োগের চাহিদা কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। কেবল পূর্ব এশিয়াতেই অবকাঠাম খাতে ২০২০ সালের মধ্যে বিনিয়োগ চাহিদা আছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বছরে সাকুল্যে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পারে। ফলে, অবকাঠাম খাতে নতুন বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই প্রয়োজন মেটানর কাজটি করতে যাচ্ছে চীনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’।
পদ্মাসেতু নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের’ মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরীর যৌক্তিকতা। বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুতে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিলের পর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যায় বাংলাদেশ। এমনকি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে অর্থায়নের নতুন পার্টনারও খুঁজে পেতে জটিলতায় পরছিল বাংলাদেশ। এই সমস্যা সমাধানে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের’ মতো প্রতিষ্ঠান সহায়ক হতে পারে।
চীনের এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র দেখছে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অবকাঠাম উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কম নির্ভরশীল হবে। এবং বিকল্প হিসেবে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দরকষাকষির মতো সুযোগও পাবে। ফলে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে।
ব্যাংকটির ৫০ ভাগ ভোটের ক্ষমতা থাকছে চীনের হাতে। এছাড়া, ব্যাংকটির নীতি নির্ধারনেও নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। অবকাঠাম খাতে বিনিয়োগের ধরণ-ধারণে চীনের কৌশলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কাছে আগের চাইতে নিজেদের পছন্দমতো সুবিধা বেছে নিতে পারবে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে উন্নয়নশীল দেশগুলোর তীব্র সমালোচনাও আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক লেনদেনের সূত্র ধরে গ্রাহক রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইস্যুগুলোতেও হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু চীন দাবি করছে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের’ মাধ্যমে গ্রাহক রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইস্যুগুলোতে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। চীনের এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও, এর প্রতি প্রলুব্ধ হবে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কেরা।
‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগটি বিচ্ছিন্নভাবে আসেনি। ব্রিকস ব্যাংক, সাঙ্ঘাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন, কনফারেন্স অব ইন্টারেকশন এন্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস ইন এশিয়ার মতো উদ্যোগের ধারাবাহিকতাতেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’। এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে এশিয়ার রাষ্ট্রনায়কেরা বিশ্ব-ব্যবস্থাপনার নতুন ফোরাম তৈরীর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগগুলোকে মৌখিকভাবে স্বাগত জানালেও আদতে তৈরী করছে নানান প্রতিবন্ধকতা। ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে’ যোগ না দিতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াকে নানান চাপে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, শেষ পর্যন্ত এই রাষ্ট্র তিনটি ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে’ যোগ দেয়নি। ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরীর পথ।