১৯৯১ সালের ২৭ মে। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা একটি ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মতিউর রহমান নিজামী এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রথমারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা রাখার দিন ঢাবির কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে বেদম প্রহার করেছিলো জনাব নিজামীকে।
ওই দিনের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছিল ১০ বছর আগে জামায়াত গুরু এবং যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ক্ষুব্ধ জনতার হাতে হেনস্তা হওয়ার ঘটনা।গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬ মামলার মধ্যে ৪ মামলায় ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ৪ মামলায় হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
১৯৮১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে আসলে বায়তুল মোকাররম মসজিদে বিক্ষুব্ধ লোকেরা নিজামীর গুরু গোলাম আযমের দিকে জুতা নিক্ষেপ করে। ফিলিস্তিনে নিহত দুই বাংলাদেশির জানাযা পড়তে সেখানে গিয়েছিলেন গোলাম আযম।
একই ধরনের গণক্ষোভের শিকার হয়েছিলেন নিজামীও। ২০০০ সালে গোলাম আযমের অব্যাহতির পর জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন নিজামী।
ঢাবির তৎকালীন ভিসি মনিরুজ্জামান মিয়ার কার্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজামীর দিকে চেয়ার ছুড়ে মারে এবং ঘুষি মারে। নিজামীর সঙ্গে থাকা ইসলামি ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদেরও পিঠিয়েছিল ক্যাম্পাসের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার পরদিন দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবিসহ খবরটি প্রচারিত হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অচলাবস্থা কাটাতে কর্তৃপক্ষ ওই দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজন করে। বিএনপি ছাড়া নিজামীসহ আমন্ত্রিত রাজনৈতিক নেতারা ভিসির কার্যালয়ে বৈঠকে উপস্থিত হন।
নিজামীর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে বাকশালের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিন থেকে মিছিল নিয়ে ভিসি কার্যালয়ে যায়। ভিসির কাছে তারা ক্যাম্পাস থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে জামায়াত নেতাকে বের করে দেওয়ার দাবি জানায়।
ক্যাম্পাসে বিশ্বাসঘাতকের উপস্থিতিতে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দেয়, ‘বুদ্ধিজীবীদের রক্তে ভেজা ক্যাম্পাসে রাজাকারের ঠাঁই নাই।‘
ছাত্রনেতারা দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গোপনে বৈঠকের আয়োজন করে এবং তাদেরকে জানানো হয়নি কারা কারা বৈঠকে অংশ নিচ্ছে।
ভিসি মনিরুজ্জামান মিয়া তার কার্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এসময় সেখানে জাসদ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নও ভিসি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়।
উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের ওই সময় শান্ত করার চেষ্টা করেন ওয়ার্কাস পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেনন ও বাকশাল নেতা মহিউদ্দিন আহমদ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের সরিয়েই ভিসির কক্ষে প্রবেশ করে।
ভেতরে ঢুকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় অভিযুক্ত নিজামীকে লক্ষ্য করে তারা চেয়ার, পানির গ্লাস, চায়ের কাপ, পেপারওয়েট, টেলিফোন সেটসহ হাতের কাছে যা পেয়েছে তা ছুড়ে মারে। এসময় তারা শ্লোগান দেয়, ‘মতিউর রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।‘
প্রায় ২০ মিনিট পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিজামীকে উদ্ধার করে। পরে তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নিজামীকে ওই সময় ৫টি সেলাই দিতে হয়।
সেসময় শিক্ষার্থীদের ওই ক্রোধ প্রকাশের ঘটনাটাই ছিল নিজামীর একমাত্র ‘শাস্তি‘। অবশেষে ওই ঘটনার ২৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।