মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের একটি উদ্যোগ চলছে। গত প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের ইতি ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে নেয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক মাধ্যমগুলো। নানা ইস্যুতে শুধু যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে নতুন বাঁক অতিক্রমের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরতের মতো দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে শুধুই আলোচনা চলছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ‘অ-দ্বিপক্ষীয়’ ইস্যু গ্রামীণ ব্যাংক— এতেও এক সময় চলে যুক্তিতর্কের খেলা। ওয়াশিংটনে সর্বশেষ হয়ে যাওয়া ‘তৃতীয় অংশীদারিত্ব সংলাপ’ (পার্টনারশিপ ডায়লগ)-এ এই বিষয়গুলোতে আগের মতোই শুধু আলোচনাই হয়েছে। তবে এবার বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করেনি যুক্তরাষ্ট্র; বিশেষত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তারা একেবারেই চুপ থেকেছে। বরং সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা সফরের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওই সফর সফল করতে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও জন কেরির মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তাব করা হবে। এবার ওয়াশিংটনেও অংশীদারি সংলাপ ও নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে বৈঠকে তেমনই কূটনৈতিক ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাশীল বৈঠক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’-এ দুদেশের ভবিষ্যতের সম্পর্কের গতিপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগের দুটি বৈঠক গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হলেও এবারের বৈঠকটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হয়েছে। কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আগে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কথা এসেছে, এবার সে ধরনের কিছুই হয়নি। বরং পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গই তোলেনি যুক্তরাষ্ট্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বচ্ছ ধারণা আছে। এ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত এবং আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভালোই জানে। এ ছাড়া এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি বাধ্যবাধকতা ছিল এমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ওই নির্বাচন প্রসঙ্গে কোনো কথা অংশীদারি সংলাপে বলেননি ওয়েন্ডি শারম্যান ও নিশা দেশাই বিসওয়াল।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিকের বক্তব্য, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও সামরিক সম্পর্ক অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। সহযোগিতার মাত্রাও আগের সময়গুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্কের শীতলতা দুদেশের সার্বিক সম্পর্কের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে, যার ফলে জনগণের উন্নয়নও হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা ছিল। বিশেষ করে গত ২০১১ সাল থেকে সম্পর্ক হয়ে পড়ে অনেকটাই শীতল। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস প্রসঙ্গ এ ক্ষেত্রে ছিল বড় একটি বাধা। এ কারণে রাজনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে প্রস্তাবিত বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই বৈঠকের সফল ধারাবাহিকতাতেই জন কেরির ঢাকা সফর এবং বারাক ওবামার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, বাংলাদেশের শ্রমমান ও শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টিও দুদেশের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন মার্কিন বাজারে দ্বিতীয় রপ্তানিকারকের অবস্থানে চলে গেছে। তাই তাদের পণ্যের ব্যাপারে এ দেশের ক্রেতাদের বেশকিছু প্রত্যাশা রয়েছে। যার মধ্যে শ্রম অধিকার, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার ও শ্রমমান একটি বড় বিষয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও কাজ করতে হবে বলে এবারের তৃতীয় অংশীদারি সংলাপেও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বলা হয়েছে।
এত কিছুর ‘করতে হবে’র মধ্যে অবশ্য মার্কিন-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক এগিয়ে গেছে। তবে সমুদ্রে বাণিজ্যপথে দস্যুতা ঠেকানো ও আঞ্চলিক সংহতি বজায় রাখতে দুদেশকে আরও কাজ করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছে দুদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, রাজনীতি ও সুশাসন নিয়ে দুদেশের মধ্যে দূরত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বহুমাত্রিক ও সম্প্রসারিত হয়েছে। দুদেশ ইতিমধ্যেই অংশীদারিত্ব সংলাপের পাশাপাশি সামরিক সংলাপ শুরু করেছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা ফোরাম (টিকফা) চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া সামুদ্রিক নিরাপত্তাসহ নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন, বাণিজ্য, দুর্যোগ মোকাবিলা, উন্নয়ন ও দুদেশের জনগণের যোগাযোগের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সম্পর্ক যতটা বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, ঠিক ততটা হয়নি। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককে তাই একটি বড় সুযোগ হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্রের খবর, আঞ্চলিক রাজনীতিতেও শেখ হাসিনার অবস্থান সুসংহত হয়েছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মে মাসে ভারতে বিজেপির নেতৃত্বের সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে শীতলতার শঙ্কা ছিল। নিউইয়র্কে গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠককে একটি ফলপ্রসূ বৈঠক হিসেবেই চিহ্নিত করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এ কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।