একের পর এক ঘটনায় সমালোচিত বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য। ঘুষ, চাঁদাবাজি, দায়িত্বে অবহেলা, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। রাজধানীসহ সারাদেশে একই অবস্থা। গত দুই বছরে ২১ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধও প্রমাণ হয়েছে। কিছু বিষয় প্রকাশ হওয়ায় জড়িতদের তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়, গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি; কিন্তু এরপর আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় না। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের একই পদে অন্য কোনো স্থানে বদলি করা হয়। তাই এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলেই অনেকে মনে করছেন।
বছর দুয়েক আগে রাজধানীর মগবাজারে ট্রাকচালকের কাছ থেকে চাঁদা নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন সার্জেন্ট জিয়া। ঘটনার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। হয়েছিল বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও। পরে সব কিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। এখন তিনি দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদপুর এলাকায়। কয়েকদিন আগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শফিকুর রহমানের ছেলে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় পুলিশের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার কাছ থেকে ৪২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এসআই রমজান ও এএসআই মারুফ। ঘটনায় রমজান ও মারুফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গঠন করা হয় বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। এখনও ফৌজদারি মামলা হয়নি। বিভাগীয় তদন্ত চলছে ঢিমেতালে।
কেবল একটি বা দুটি ঘটনা নয়, একের পর এক ঘটনায় আলোচিত কতিপয় পুলিশ সদস্য। কিছু বিষয় জনসম্মুখে চলে আসায় জড়িতদের সাময়িক বরখাস্ত বা তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এরপর আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় না। এক পর্যায়ে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যও যোগ দেন কাজে।
সূত্র মতে, গুরুতর ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের পর তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে যে শাস্তি দেয়া হয়, তা নামমাত্র।
পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, প্রত্যাহার আর সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তি নয়। পত্রিকায় বা অন্য মাধ্যমে কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার প্রাথমিক অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টকে প্রত্যাহার করা হয়। তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ গুরুতর হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি গঠনের পর যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন, সেটি শাস্তি হিসেবে বিবেচিত। প্রত্যাহার হওয়া কর্মকর্তাকে পরে যে কোনো জায়গায় পোস্টিং দিতে কোনো আইনি বাধা থাকে না বলে তিনি জানান।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপরিচালক মাসুদুর রহমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী— ভাটারা থানার এএসআই সিরাজুল ইসলাম, কায়সার আহমেদ ও কনস্টেবল আবদুর রহমান শুক্রবার রাতে ভাটারার ২৫/১২ সাইফনগরের লিটনের বাড়ি থেকে ফিলিপস কোম্পানির টেকনিশিয়ান শাহজাহান ও বর্ষা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের থানায় না নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে রাজধানীর বিভিন্নি এলাকা ঘোরাতে থাকে। পাশাপাশি শাহজাহানের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। শাহজাহানকে এই বলে হুমকি দেয়া হয়— রাতের মধ্যে টাকা না দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হবে এবং রিমান্ডে আনা হবে। বিষয়টি শাহজাহান মোবাইল ফোনে তার ভাগ্নে আবির হোসেনকে জানান। পরে আবির বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এরপর গুলশান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে বিষয়টির সত্যতা পায়। পরে এই তিন পুলিশসহ গাড়িচালক আসাদুজাামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মধ্যে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করা হয়েছে।
কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত আক্রোশে এক ব্যক্তির পায়ে গুলি করার অপরাধে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে ওই থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। ওসির বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অথচ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ওসি এই ঘটনার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
গত ৫ অক্টোবর উদ্ধার করা ফেনসিডিল বিক্রির অভিযোগে তুরাগ থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসাইনসহ চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। অন্য সদস্যরা হচ্ছেন এসআই খোকন চন্দ্র ঘোষ, এএসআই মামুনুর রশিদ, এএসআই আহসান হাবিব। ১৫ অক্টোবর বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদে ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ভাসানটেক থানার ওসি হোসনে আরাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর আগে একই ঘটনায় থানার পরিদর্শক ও ভাষানটেক পুলিশ ফাঁড়ির এক এসআই ও ওসিসহ (তদন্ত) ১৯ পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়। গত ২৩ জানুয়ারি কাফরুলের ওসিসহ ৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
গত ১ সেপ্টেম্বর সেনাসদস্যকে লাঞ্ছনার দায়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। তারা হচ্ছেন দৌলতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রাশেদুল আলম ও কনস্টেবল আল মামুন। তবে বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত ৯ অক্টোবর ইয়াবাসহ তিন যুবককে আটকের পর ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের রাউজানের কাগতিয়া বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জসহ এসআই নাঈমউদ্দিনসহ তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়। গত ১৬ সেপ্টম্বর খুলনা জেলার কয়রা থানার ওসি সুবীর দত্তকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে প্রত্যাহার করে খুলনা জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। এ ঘটনার আগের রাতে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী এলাকায় বিনা টিকিটে সার্কাস দেখা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হন। এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় ওসি সুবীর দত্তকে প্রত্যাহার করা হয়।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে বছরের ৪ সেপ্টেম্বর। ওইদিন রাত ১০টার দিকে খিলগাঁও এলাকায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে ছেলে সায়মন নিহত হয় এবং বাবা ইসরাইল হোসেন গুরুতর আহত হন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম শেখকে দেখতে না পেয়ে মোবাইল ফোনে কল করেন; কিন্তু তিনি ওই সময় বেসামাল অবস্থায় ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলেন। এ কারণে পরদিন তাকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তার অবস্থান গুলশান এলাকায় দেখতে পান পুলিশ কর্মকর্তারা। এতো কিছুর পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরের বোয়ালিয়া থানা এলাকায় জুয়া খেলা কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে হাতে লাঠি নিয়ে অন্য পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অ্যাকশনে নামে আকাশ, শাকিল ও রাসেল নামের তিন যুবক। এ বিষয়টি জানাজানি হলে ওসি এসএম আবদুস সোবহানকে প্রত্যাহার করা হয়।
প্রত্যাহারের পর কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নে ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, সব বিষয় আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে ভালো করে জেনে বলতে হবে।