প্রতিষ্ঠার ৫৯ বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর এখন অনেকটাই টালমাটাল অবস্থা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতও অভিযুক্ত।
একের পর এক নেতাদের মৃত্যুদণ্ড, জেল-জরিমানার ঘটনায় ভেঙে পড়েছে দলটির নেতৃত্ব। হুমকির মুখে নেতাকর্মীদের ভবিষ্যত্ ও দলের অস্তিত্ব। মাথার ওপর ঝুলছে নিষিদ্ধের খড়্গ। এ নিয়ে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সংশোধন করা হচ্ছে আইন। সব মিলিয়ে কঠিন দুঃসময় পার করছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াত নেতাকর্মীরা যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত তাদের শীর্ষ নেতা এবং দলের অস্তিত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি দলীয়ভাবে এবং জোটের কর্মসূচিতে টিকে থাকার চেষ্টা করবে।
তবে সরকারের কঠোর অবস্থান ও দলীয় বিপর্যয়ের মধ্যে সামনের দিনগুলোতে কতক্ষণ টিকে থাকা যাবে তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কারণ হরতালের মতো কঠিন কর্মসূচিও এখন সফল হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনকার মতো বিপর্যয়ের মুখে কখনও পড়তে হয়নি জামায়াতকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একের পর এক শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, জেল-জরিমানা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমার কারণে ক্যাডারভিত্তিক এই দলটি বর্তমানে চরম নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়েছে। নেই কোনো চেইন অব কমান্ড। নেতাকর্মীরাও দিশেহারা। কর্মসূচি দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা চললেও মাঠে নামতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। কেবল নামমাত্র হরতাল, ঝটিকা মিছিল, বোমাবাজি ও বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যেই পদ-পদবিসহ নানা বিষয় নিয়ে দলটিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক নির্বাহী পরিষদ সদস্য দাবি করেন, জামায়াত কখনও ভেঙে পড়ার দল নয়। নেতৃত্ব নিয়েও কোনো সঙ্কট নেই। সরকার পুলিশ ও র্যাব দিয়ে কর্মসূচি পালনে বাধা দিচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে জামায়াতকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছরেও দলটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করা যায়নি।
২০১০-১১ সেশনের জন্য মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেন্দ্রীয় আমির এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ওই বছরে ইসলামের অবমাননা, দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার ও যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর কোনো নির্বাচন হয়নি। সেই থেকে ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে চলছে দলীয় কার্যক্রম। এর ফলে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্রমতে, জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ, নীতিনির্ধারণী ফোরাম মজলিসে শূরা ও কর্মপরিষদ আগের মতো সক্রিয় নয়। বিপর্যয়ের কারণে চেষ্টা করেও এসব গুরুত্বপূর্ণ উইংগুলো গঠন করতে পারেনি জামায়াত। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আমির নিজামী, নায়েবে আমির সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি কামারুজ্জামান, নির্বাহী পরিষদ সদস্য কাসেম আলী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে রায় কার্যকরের অপেক্ষায় গ্রেপ্তার আছেন। সহকারী সেক্রেটারি কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে রায়ের অপেক্ষায় আছেন নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি এটিএম আজহারুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। এছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে মারা গেছেন নায়েবে আমির একেএম নাজির আহমদ ও একেএম ইউসুফ। বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন সহকারী সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
তার অবর্তমানে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনায় চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে মামলায় আত্মগোপনে আছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, কো-অপ্ট হওয়া সহকারী সেক্রেটারি ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি ও মহানগর আমির মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, প্রচার সম্পাদক তাসনিম আলম, নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম মাসুম, আব্দুল হালিম, সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরসহ কেন্দ্রীয় অধিকাংশ নেতাই পলাতক। মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতাকর্মীই পলাতক রয়েছেন। মাঠে নামানো যাচ্ছে না নেতাকর্মীদের। এর মধ্যেই পদ-পদবি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে একাধিক পদ দখলের অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা নিয়ে শিবিরের সাম্প্রতিক বক্তব্য, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতাদের বাদ দিয়ে নেতৃত্ব পুনর্গঠন, দলের অস্তিত্ব রক্ষায় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা এবং বিপদের সময় বিএনপির সহযোগিতা না পাওয়ায় ২০ দলীয় জোটে থাকা না-থাকাসহ সবকিছু নিয়ে জামায়াত নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য আরও বাড়ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায়, আইনি লড়াইয়ে সুবিধা করতে পারছে না যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াত। দেশ-বিদেশের আইনজীবী নিয়োগ করেও শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করতে পারছে না। মামলা করে দীর্ঘদিন ধরে তালামুক্ত করতে পারেনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একই অবস্থা ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাখা অফিসের। সেই সঙ্গে আর্থিক সঙ্কটের কথাও শোনা যাচ্ছে।
জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বে শিবিরের সাবেক নেতাদের প্রাধান্য বেড়ে যাওয়ায় তৃণমূলে জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। তবে সাবেক শিবির নেতাকর্মীরা পুরনো নেতৃত্ব বাদ দিয়ে দলকে পুনর্গঠন করার পক্ষে। তাদের মতে, আন্দোলন-সংগ্রামে শিবির অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে— পুরনো নেতৃত্ব ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ অবস্থায় শিবির নেতাদের দিয়ে নেতৃত্ব পুনর্গঠন করা হলে জামায়াত তৃণমূলে শক্তিশালী হবে। স্থবিরতা কাটিয়ে উঠবে এবং মাঠে নেমে কর্মসূচি পালন করবেন নেতাকর্মীরা।