দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে লাল কাপড়ে সংক্ষিপ্ত আদেশটি বিচারিক আদালতে পৌঁছার পরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুপরোয়ানা জারি করবে। এ ক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না বলে অধিকাংশ আইনজীবী মনে করেন।
বুধবার সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রস্তুতি চলছে। জেল কোড ও আইন মেনে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় নয়— সংক্ষিপ্ত রায়ের লিখিত কপি থেকেই রায় কার্যকর করা যাবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, ফাঁসি কার্যকর করতে কোথাও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কথা বলা হয়নি। আপিল বিভাগের একটি নজির আছে রিভিউ খারিজ হওয়ার। কারাগার সূত্র জানিয়েছে, রায় কার্যকরে কারা কর্তৃপক্ষ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
বুধবার ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন আইনমন্ত্রী ও আইজি প্রিজন। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পর পরই আইনমন্ত্রী ও আইজি প্রিজন এক সঙ্গে বের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে যান। বুধবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের আগেও আইজি প্রিজন আইনমন্ত্রীর সঙ্গে এমন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন বলেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। সেবারও আইনমন্ত্রী একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন।
এদিকে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে রায়ের পরদিনই (মঙ্গলবার) কাসিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার মহড়া সম্পন্ন হয়েছে। একজন দক্ষ কয়েদি যিনি এর আগে কাদের মোল্লাসহ একাধিক ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করেছেন তার নেতৃত্বে জেল কর্তৃপক্ষ ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে চূড়ান্ত মহড়া সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে নিয়মিত সাক্ষাতের অংশ হিসেবে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেছেন।
কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার জন্য বুধবার সন্ধ্যায় তার আইনজীবীরা আবেদন করেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের কাছে এ আবেদন নিয়ে আসেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। অন্য সাক্ষাত্প্রার্থীরা হচ্ছেন— অ্যাডভোকেট গাজী এম এইচ তামিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার নাজীব মোমেন, অ্যাডভোকেট মশিউল আলম। আবেদনে বলা হয়, কামারুজ্জামান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় কারাগারে অন্তরীণ আছেন। ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশিত হয়েছে। আপিলের রায়ের বিষয়ে মক্কেলের দিকনির্দেশনার জন্য বৃহস্পতিবার আমরা সাক্ষাত্ করতে চাই। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের জন্য আলাদা কক্ষে সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়া হয় ওই আবেদনে।
কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে রাখা হয়েছে কনডেম সেলে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগারের যারা ফাঁসি কার্যকর করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে তাদের নিয়েই একটি পরিপূর্ণ মহড়া সম্পন্ন করা হয়েছে। যে জল্লাদ এই ফাঁসি কার্যকর করবেন তাকেও এই মহড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ওই সূত্র আরও জানায়, কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার ব্যাপারে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। তারা লিখিত রায় হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে লাল কাপড়ে মোড়া ওই লিখিত রায় ঠিক কখন পৌঁছতে পারে তা নিশ্চিত নয় কারা কর্তৃপক্ষ। এদিকে ওই রায় হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও। সুপ্রিমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কুদ্দুস জামান বর্তমানকে বলেন, বুধবার বিকাল পর্যন্ত চার বিচারপতির স্বাক্ষরসহ সংক্ষিপ্ত আদেশটি এখনও হাতে পাইনি। হাতে পেলেই তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সূত্র মতে, বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের আদেশ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছতে পারে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশ বিচারিক আদালতে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো সুপ্রিমকোর্ট চাচ্ছে রায় কার্যকর করতে। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করতে ট্রাইব্যুনালের কোনো বাধা নেই। আর সরকার নির্বাহী আদেশে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে জেল কোড বা সুপ্রিমকোর্টের বিধি প্রযোজ্য হবে না।
জানা গেছে, আগামী রবিবারের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় চার বিচারপতির স্বাক্ষরসহ বিচারিক আদালতে পাঠানো হতে পারে। আর এটা পাঠানোর অর্থই হচ্ছে বিচারিক আদালতকে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করতে বলছে উচ্চ আদালত। মৃত্যুপরোয়ানা জারি হলে জেল কোডের কোনো বিধান এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের বিষয়টি এখন নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। সরকার চাইলে তাকে সংক্ষিপ্ত আদেশের বলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে না।
অন্যদিকে আপিলে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে না। আর পূর্ণাঙ্গ রায় পেলেই আমরা রিভিউ পিটিশন দায়ের করব। এর আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন।
তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন একটি বিশেষ আইন। এই বিশেষ আইনে রিভিউ করার কোনো সুযোগ নেই। কাদের মোল্লার ফাঁসির ক্ষেত্রেও এ কথাই বলেছিলাম। তখন যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন তারাও আজ বলছে বিশেষ আইনে রিভিউ করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশন খারিজ করার সময়ই এটা উল্লেখ করা উচিত ছিল যে বিশেষ আইনে রিভিউয়ের সুযোগ নেই। তবে অন মেরিট (আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা) কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনটি খারিজ করে দেয় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। এ ক্ষেত্রেও রিভিউ করা হলে খারিজ হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সোহাগপুরের গণহত্যার অপরাধে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেই সোমবার তার রায় ঘোষণা করে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। তবে সে রায় লিখিত আকারে ট্রাইব্যুনালকে পাঠানোর পরেই শুরু হবে এর পরবর্তী কার্যক্রম। ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে লাল কাপড়ে মোড়ানো রায় পেলেই পরবর্তী উদ্যোগগুলো নেবেন তারা।