তানহা (ছদ্মনাম) পড়তেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান । পড়াশুনা শেষ করে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বখে যাওয়া বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হন। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় একটি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে।সেখানে কোনো উন্নতি না হওয়ায় ভর্তি করা হয় তেজগাঁও জাতীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। এখন তিনি নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিবারের সহায়তায় সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু জীবন থেকে চলে যাওয়া ৪টি বছর তাকে মাঝেমাঝেই হতাশাগ্রস্ত করে।
শুধু তানহা ও তানহার পরিবার নয় । মাদকের ছোবলে জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেকের সন্তানের। মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা দিন কাটাচ্ছে অনেক পরিবার। আর সেই সন্তান যদি হয় মেয়ে তার যন্ত্রণা তো দ্বিগুণ!চিকিৎসা সেবার সীমাবদ্ধতা, সামাজিক মূল্যবোধ নানা কারণেই মাদকাসক্ত মেয়েকে নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় অভিভাবকদের।
রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশা্নের বিভিন্ন এলাকা ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমণ্ডি লেকসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন বসয়ী নারীদের প্রকাশ্যে মাদক গ্রহণের দৃশ্য চোখ পড়ে। এদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্করাও আছে।
বেসরকারি জরিপের হিসাবে, সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্ত ৫ লাখ।
অন্যদিকে মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি)জরিপে দেখা যায়, সারা দেশে ৪০ লাখের বেশি মাদকাসক্ত। এতে নারীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া না থাকলেও চার লাখের কাছাকাছি বলে জানা গেছে।
মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আসক্ত হয়ে পড়ে।
এছাড়া, রাজধানীসহ সারাদেশে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর অবস্থা তেমন একটা ভালো না। জাতীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একই জায়গা হওয়ার কারণে অধিকাংশ জায়গায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অবস্থিত।
সারা দেশে অনুমোদিত ৯০টি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র আছে। এছাড়া চিকিৎসার নামে বাণিজ্য চলছে এমন প্রতিষ্ঠান আছে ৫০০। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী মাদকাসক্তদের নিরাময়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান কার্যালয়সহ সারা দেশে মোট চারটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রয়েছে। সেগুলোতেও নারীদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীতে ‘ক্রিয়া’ ও ‘আপন ’ নামে দু’টি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ছাড়া নারীদের জন্য আলাদা কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই। তবে সম্প্রতি আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তদের জন্য মোহম্মাদপুর ইকবাল রোডে আলাদা কেন্দ্র চালু করেছে।
জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান পরামর্শক ডা. ইমামুল হোসেইন বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের জন্য চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নারীদের জন্য সেই ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য দক্ষ কাউন্সিলার ও চিসিৎসক দরকার। এ ক্ষেত্রেও অভাব রয়েছে নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে। তবে তেজগাঁও মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট আরেকটি বিভাগ খোলার কথা আছে। এখানকার ৩০ শতাংশে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার পরিবেশ নেই বললেই চলে। এর কারণ আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা। তারপরও সরকার থেকে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়।তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে একটি বরাদ্দ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।’
মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে জটিলতা কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসার চেয়ে সুস্থ হওয়ার পর পুনর্বাসনের ব্যাপারটা কঠিন ডাইমেনশন। দেখা যায়, রাস্তা থেকে একটি রোগীকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করানোর পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে সে আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।’
মাদক বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীদের মাদকাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশ ও সমাজের জন্য তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কারণ নারীরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণ করেন। নারীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে এর প্রভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পঙ্গু হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম. রশীদ চৌধুরী বাংলামেইলকে বলেন, ‘মাদকদ্রব্য বিস্তারের কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের দেশের যুবসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর থেকে বাদ যাচ্ছে না নারীরাও। বিশেষ করে স্কুলে মেয়েরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা জানি নারীরা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করে। যদি নারীরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। নারীরা মা, তার সন্তান থাকলে বা না থাকলেও লালন পালন করেন। এজন্যে নারীদের মা রূপে মূল্যায়ন করতে হবে । তিনি যদি নিজে নষ্ট হয়ে যান তাহলে তার সন্তান, পরিবারের বাকি সদস্যরা ও একটি সংসার নষ্ট হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা পুরুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা যায় সহজেই। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সামাজিক কারনেই কোনো নিরাময় কেন্দ্রে কম ভর্তি করা হয়। আর মাদকাসক্তের কারণে পুরুষদের তুলনায় নারীর শরীরের বেশি ক্ষতি হয়। মাদক সেবনের ফলে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আর গর্ভবতী হলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দেয়।’
এই ভয়াবহ প্রবণতা থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের প্রতি তিনি বলেন, ‘মেয়েদের মাদক থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তানদের সময় দিতে হবে। সন্তান কী করছে কার সঙ্গে মিশছে এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। যদি দেখেন আপনার মেয়ে উগ্র আচরণ করছে বা তার আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিন।স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে তার কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করুন। মেয়ে বলে অবহেলা করবেন না। একজন সুস্থ নারীই পরে একটি সুস্থ জাতি নির্মাণ করতে পারে।’
মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাকে মাদকাসক্তের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজকাল রাস্তাঘাটে সহজে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। এমনকি স্কুলের দারোয়ানরা পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী মাদক সরবারহ করছে। এছাড়া নিউমার্কেটে কিছু দোকানে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। এছাড়া পারিবারিক অশান্তি, যে কোনো ধরনের হতাশা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, প্রেমঘটিত ব্যাপার,ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব,মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গ- এসব কারণেই আজ তরুণরা এই মরণ নেশায় আসক্ত হচ্ছে।’
এভাবে চলতে থাকা মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে ঐশীর মতো ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে বলে সতর্ক করে দেন বিশেষজ্ঞরা।