জেএমবি নেতা হিসেবে যার মাথার দাম ভারতে ১০ লাখ রুপি ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই সাজিদ কি নারায়ণগঞ্জের মাসুম মিয়া- তা এখনও নিশ্চিত নয় বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পশ্চিমবঙ্গে সাজিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারতের সংবাদ মাধ্যমে তার বাড়ির যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সেই এলাকায় গিয়ে মাসুমের খবর জানা গেলেও সাজিদ নামে কারও নাম শোনা যায়নি।
বন্দর উপজেলার ফরাজীকান্দা এলাকার মাসুমকে ‘সাজিদ’ ধরে নিয়ে তার ভাইকে আটক করে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান সাংবাদিকদের বলেন, তারা পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন।
আর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, “বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাজিদই ফরাজীকান্দা এলাকার মাসুম কি না, তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই।”
গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে কথিত জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণে দুজন নিহত হওয়ার পর তাতে বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানায় ভারতের গোয়েন্দারা।
এরপর ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নামার পর সন্দেহভাজন ১২ জনকে চিহ্নিত করে তাদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দেয়।
তাতে সাজিদ ওরফে শেখ রহমাতুল্লাহ ওরফে বুরহান শেখ নামে একজনের জন্য ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে এবং তার বাড়ি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ফরাজীকান্দায় বলে উল্লেখ করা হয়।
এরপর গত শনিবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাজিদকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ওই রাজ্যের পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার আদালতের মাধ্যমে নিজেদের হেফাজতে নেয় এনআইএ।
এদিকে ভারতের গণমাধ্যমে সাজিদের নারায়ণগঞ্জের বাড়ির খুঁটিনাটি প্রকাশের পর সোমবার রাতে র্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের ফরাজীকান্দা এলাকায় গিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করে, যার নাম মোনায়েম হোসেন মনা।
ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি মনাই কথিত সাজিদের ভাই বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সন্দেহ; যদিও স্থানীয়রা মনার এক ভাইয়ের নাম মাসুম মিয়া ওরফে মাসুদ বলে জানে, সাজিদ নামে কাউকে চেনে না।
মনা বাড়ির কাছেই একটি ওয়ার্কশপে কাজ করেন। সেখান থেকে তাকে ধরে আদমজীতে র্যাব-১১ এর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।
র্যাব-১১ এর অধিনায়ক আনোয়ার লতিফ বলেন, “সাজিদ কিংবা মাসুমের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য মনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।”
“মাসুমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আমার স্বামীকে নিয়ে গেছে,” বলেন মনার স্ত্রী সীমা আক্তার।
তবে মনাকে জিজ্ঞাসাবাদে তার ভাই মাসুমের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
“তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভারতে যে গ্রেপ্তার হয়েছে, সে মনারই ভাই,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ওই কর্মকর্তা।
পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দিন বলেন, “গণমাধ্যমে প্রচারিত এই সংক্রান্ত (সাজিদের বিষয়ে) সংবাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।”
মনার বাবা সিদ্দিক মিয়া পাটকল শ্রমিক ছিলেন। সিদ্দিক মারা গেছেন, তার স্ত্রীও অসুস্থতা নিয়ে শয্যাশায়ী। তাদের ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে মাসুমই ছোট বলে এলাকাবাসী জানায়।
মঙ্গলবার দুপুরে ফরাজীকান্দা এলাকায় মাসুমের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে মনার স্ত্রী সীমা ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি।
তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাসুম ওরফে মাসুদ নামে মনার এক ভাইকে চেনেন তারা। তবে সে অনেকদিন ধরে বাড়িতে থাকে না।
সোমবার সকাল থেকে ছোট চুলের অচেনা কয়েজন ব্যক্তিকে এলাকায় দেখে এলাকাবাসী। সন্ধ্যার পর ওয়ার্কশপ থেকে মনাকে ধরে নেওয়ার পর তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান বুঝতে পারে।
ভারতে মাসুম আটক হওয়ার খবর শুনেছেন বলে এলাকার কয়েকজন জানান, তবে মাসুমের নাম ‘সাজিদ’ বলে কখনও শোনেননি বলেও তারা জানান।
মনার স্ত্রী সীমা বলেন, তার দেবর মাসুম ভারতে হামলায় জড়িত বলে সোমবার বিভিন্নজনের কাছে শুনেছেন তিনি।
“গতকাল (সোমবার) সকাল থেকেই পুলিশ বাড়িতে আসছিল। তারাই বলে যে মাসুম-ই ভারতে হামলাকারী সাজিদ। কিন্তু আমরা কখনোই মাসুমকে সাজিদ নামে ডাকিনি।”
ডাকাতির মামলা ছিল মাসুমের নামে
জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে এখন আলোচিত হয়ে উঠলেও মাসুমের নামে গোপালগঞ্জে একটি ডাকাতির মামলা ছাড়া অন্য কোনো অভিযোগ পুলিশের নথিতে নেই।
গণমাধ্যমে খবর এবং মনা আটক হওয়ার পর মাসুমের বিষয়ে বন্দর থানায় কাগজপত্র তল্লাশি শুরু হয়। এতে ‘মাসুম, পিতা-মৃত সিদ্দিক ওরফে পচা, বাড়ি ফরাজীকান্দা’ নামে একজনের একটি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে বলে বন্দর থানার ওসি নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন।
কলকাতায় গ্রেপ্তার সাজিদ
মামলাটি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানার একটি ডাকাতি মামলা। ওই মামলায় ২০০০ সাল পর্যন্ত মাসুম গোপালগঞ্জের কারাগারে থেকে সাজা শেষে বেরিয়ে আসেন।
এরপর থেকে তার সঙ্গে বাড়ির কারও সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই বলে তার ভাই স্কুলশিক্ষক মামুন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “মাসুম আমাদের বলেছিল, টুঙ্গীপাড়ার একটি জামে মসজিদে ইমামের চাকরি করত সে। ওই মসজিদ কমিটির অন্তর্দ্বন্দ্বে তার বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়েছিল।”
মাসুমের ভাবি সীমা জানান, তার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর অর্থাভাবে মাসুমকে যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায় দেওয়া হয়, মাদ্রাসার খরচেই সে পড়াশোনা করত।
আদালতে দেওয়া সাজিদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে, সাজিদ বাংলাদেশে অপরাধ করে বাঁচার জন্য ভারতে পালিয়েছিল।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে জেএমবির বোমা হামলার পরের বছর ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে বোমাসহ মাসুমের গ্রেপ্তার হওয়ার একটি খবর তারা শুনেছিলেন। পরে জামিনে বের হওয়ার পর মাসুমকে দুবাই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানায়।
মাসুমের নামে আর কোনও অভিযোগ রয়েছে কি না, সে বিষয়ে আরও খোঁজ-খবর নেবেন বলে বন্দর থানার ওসি জানিয়েছেন।
জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিনের বাড়িও নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ এলাকায়।
সালাহউদ্দিনসহ তিনজনকে গত বছর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে নেওয়ার পথে পুলিশকে মেরে ছিনিয়ে নেয় তার সহযোগীরা। এরপর দুজন ধরা পড়লেও সালাহউদ্দিনের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।