বিএনপি চেয়ারপারসন এখন অনেকটা কঠিন সময় পার করছেন। দল গোছানো ও আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা কোনোটি গুছিয়ে করতে পারছেন না। কূটনৈতিক যোগাযোগ আরো জোরালো করা দরকার হলেও তা করতে পারছেন না। কূটনীতিকরা আগাম নির্বাচন চাইছেন কিন্তু এর জন্য বিএনপি সরকারের ওপর যতখানি চাপ তৈরি করা দরকার তা পারছে না। এই কারণে তারা কিছুটা ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছেন।
এই অবস্থায়ও বিএনপি লক্ষ্যে পৌঁছতে বিভিন্নভাবে এগোনোর চেষ্টা করছে। তবে সরকারের তরফ থেকে নানমুখী বাধার কারণে দলটি যতটুকু এগোচ্ছে আবার ততখানি পিছিয়ে যাচ্ছে। দলের নেতাদের অনেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার কারণেও যথা সময়ে সাফল্য আসছে না বলেও মনে করছেন। একক কোনো নেতার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না খালেদা।
এ কারণে তার সঙ্গে দেখা করার ও যোগাযোগ করার যে দেয়াল ছিল তা তুলে নিলেন খালেদা জিয়া। এই প্রথম যেকোনো সময় তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বললেন নেতাদের। এর আগে নেতারা চাইলেও তার সঙ্গে দেখা করতে ও কথা বলতে পারতেন না। সেটা এখন থেকে তিনি আর রাখতে চান না। তিনি মনে করছেন, তাকে নেতারা সমস্যার কথা জানাতে পারলে সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে এই দলটির রাজনৈতিক কোনো সাফল্য নেই, কেবল কয়েকটি সফল সমাবেশ করা ছাড়া। তাতেও রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো প্লাস পয়েন্ট যোগ করতে পারেনি। জনগণকে আস্থার মধ্যে আনতে পারেনি। জনগণ ভোট হলে সেই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসাবে বিএনপিকে ভাবতে পারে তবে বিএনপিকেই ভালবেসে যে ক্ষমতাসীন করবে পরিস্থিতি সেই রকম নয়।
এটা করার জন্য বেগম খালেদা জিয়া বারবার চেষ্টা করছেন তবে তা পারছেন না। কারণ তার নেতাদের মধ্যে যারা এই ব্যাপারে কাজ করবেন তাদের অনেককে নিয়েই সমস্যা রয়েছে। যেখানে বেগম খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যাচ্ছেন সেখানে একটি অনুষ্ঠানের যত সাফল্য আসছে অন্য নেতারা গেলে ততটা সাফল্য আসছে না।
আগামী দিনে মাঠে থাকার জন্য তার উপদেষ্টাদের মধ্যে রিয়াজ রহমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মাহমুদুল হাসান, উকিল আবদুস সাত্তার, এজেডএম জাহিদ হোসেন, অধ্যাপক এমএ মান্নান, ফজলুর রহমান পটল, মুশফিকুর রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আহমেদ আযম খান, শামসুজ্জামান দুদু, অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, খন্দকার শহিদুল আলম, মুহাম্মদ হায়দার আলী, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাউদ্দিন, মীর মুহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, জয়নাল আবেদীন, এএসএম আবদুল হালিম, রুহুল আলম চৌধুরী, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, শওকত মাহমুদ, জহুরুল ইসলাম, এমএ কাইয়ুম, মঞ্জুর আলমকেও নির্দেশ দিয়েছেন। তারা তাদের নিজ নিজ জেলাগুলোতেও আন্দোলন সফল করার জন্য কাজ করবেন। সেই সঙ্গে তাদের জেলাসমূহে যেই সব সমস্যা রয়েছে দলের ভেতরে সেগুলোও তাকে অবহিত করবেন। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশও করবেন। এর আগে তাদের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না। নির্বাহী কমিটি ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দাপটে তারা অনেকটাই কোণঠাসা।
বিএনপির লক্ষ্য ছিল ২০১৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে যে করেই হোক দল গুছিয়ে আনা। আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। সরকারের ওপর নির্বাচন দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হবে। সরকারকে দেশের ভেতরে জনগণকে দিয়ে চাপ দেওয়ানো ছাড়াও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও বিএনপির ডাকে ও অনুরোধে সারা দিয়ে সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ তৈরি করবে। কিন্তু বিএনপি এর কোনোটি করতে পারেনি। তা করতে না পারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেয়নি ও তারা এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে এই জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারকে বারবার বলেছে।
কিন্তু তাদের এই বলাটা সরকার তেমন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেশের ভেতরে বিএনপি তেমন চাপ তৈরি করতে না পারার কারণে তারা এতদিন কিছুই করতে পারেনি। মাঝে মাঝেই তারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে। সরকার তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। তারা পারেনি। তবে সরকারের সঙ্গে তারা স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ফলে এই বছরের মধ্যে আগাম নির্বাচন করানোর যে চেষ্টা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ছিল বিএনপির সেই ধরনের শক্তি না থাকায় তারা তা পারছে না। এটা বিএনপির একটা বড় ব্যর্থতা। সূত্র জানায়, বিএনপি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকারি ছিল, তারা সেটাও পুরোপুরি করতে পারেনি। ফলে এই ক্ষেত্রে দলটি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মার্চ ফর ডেমোক্রেসির কর্মসূচির ব্যর্থতা এখনও এই দলটিকে বহন করতে হচ্ছে। কারণ ওই দিন এমন কোনো নেতা ছিলেন না সরকার যখন বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি, আটকে রাখে সেদিন একটি সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি দিতেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে। একটি মিছিল পর্যন্ত তার বাড়ি অভিমুখে কোনো নেতা নিয়ে যেতে পারেননি। তারা মার্চ ফর ডেমোক্রেসিও সফল করেননি। কেউ মাঠেও নামেননি। ওই সময় থেকেই যে নেতাদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হয়েছে সেটা এখনও কাটেনি। এটা বেগম খালেদা জিয়াও ভালো করেই জানেন।
এই কারণে তিনি আর চান না ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। তিনি চাইছেন আগামীতে সরকার পতনের জন্য যে কর্মসূচি দিবেন তা যেন সফল হয়। আর এই জন্য কোনো নেতাকে যাতে অন্য নেতার জন্য অপেক্ষা করতে না হয় বরং বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন দিক নির্দেশনা এবং কখন কি করণীয়। এতদিন তিনি কিছু কিছু নেতার সঙ্গে নিয়মিত কথা বললে ও দেখা করলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাও তার সঙ্গে কথা বলতে ও দেখো করতে পারতেন না। কিন্তু এখন তিনি বিবেচনা করে দেখেছেন এতে তার ও দলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এই কারণে তিনি সেটার সমাধান করতে চান।
তিনি সোমবার রাতে উপদেষ্টাদের বক্তব্যের পর খালেদা জিয়া তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই আপনাদের সঙ্গে বৈঠক করছি। দেখেছেন ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই অন্য অঙ্গ সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করা হবে। দলকে সুসংগঠিত করার জন্য সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেটা করার পরই চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি নেতাদের আরো বলেন, তবে আপনারা যে যেখানে আছেন সেখান থেকে নিজ দায়িত্বে কাজ করবেন। এটাও তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে তারা যেন মাঠে থাকেন। এই জন্য বলেছেন আপনারাও নেতাকর্মীদের সঙ্গে থাকবেন। প্রয়োজন হলে যেকোনো সময় আমার সঙ্গে কথা বলবেন।
এই ব্যাপারে তার একজন উপদেষ্টা বলেন, অনেক সময় আমরা ম্যাডামের কিংবা দলের মহাসচিবের কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করি। তারা নির্দেশ না দিলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করতাম। কিন্তু এখন আর সেটা হবে না। কারণ ম্যাডাম নিজেই তার সঙ্গে প্রয়োজনের জন্য যোগাযোগ করতে বলেছেন। ফলে আমাদের সিদ্ধান্তহীনতায় থাকতে হবে না। কোনো নেতা নির্দেশ না দিলেও আমরা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলেই জেনে নিতে পারবো আমাদের কি করতে হবে।
নেতারা যাতে জামায়াতের সঙ্গে কোনো দূরত্ব না রাখে ও জোটের সঙ্গে কোনো দূরত্ব তৈরি না হয় সেই জন্যও তাদের সঙ্গে সুম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছেন। তিনি এটাও নেতাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে কোনো অনৈক্য নেই। প্রচারণা চালানো হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আমাদের । এর কোনো ভিত্তি নেই। কারণ বাস্তবে এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। কেবল জোট নয়, জোটের বাইরেও যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলার কাজ করা হচ্ছে। সেটাও সফল করতে হবে।
আর এসব দিক বিবেচনা করেই আন্দোলনের কৌশল, দলের পুনর্গঠন নিয়ে কথা বলছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠকে আরো বেশি আলোচনা করবেন। তবে নেতারা বেগম খালেদা জিয়াকে দল পুনর্গঠন ও আন্দোলন একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। অঙ্গ সংগঠনগুলোর কমিটি পুনর্গঠন এবং সম্ভব হলে দ্রুত জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেও এই বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন। আগামী দিনের আন্দোলনে বিএনপি যাতে কোনো ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত না নেয় সেই চেষ্টাও চলছে।
খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টা বলেন, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, চলমান আন্দোলন, দলের পুনর্গঠনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ভাবছেন। আর সেই হিসাবে কাজও করছেন। এই সব সমস্যা সমাধানের জন্য দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন। খালেদা জিয়া চাইছেন আরো পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে। যাতে করে কোনোরকমভাবেই তাদেরকে ব্যর্থতা লেখাতে না হয়।
আর এই কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা ও নির্বাহী কমিটির সদ্য নেতারাও মাঠে থাকবেন। তারা মাঠে থেকে অন্য নেতা-কর্মীদের উৎসাহ জোগাবেন। তারা মাঠে না থাকলে বিএনপির আন্দোলন সফল করা কঠিন হবে। কারণ এই পর্যায়ের নেতারা না থাকলে বিএনপি আবারও আন্দোলন সফল করতে ব্যর্থ হতে পারে। সেই হিসাবে তিনি এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পাশাপাশি জোটের আকার বড় করে হোক কিংবা দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট না হলেও যুগপত আন্দোলন করতে চান। সেই জন্য অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীরসহ তার নেতৃত্বে যে একটি জোট হওয়ার কথা ছিল ওই জোটকেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পাশে রাখতে চান। সেটা করার জন্য বিএনপি যে সুসংগঠিত ও শক্তশালী দলে পরিণত হয়েছে সেটাও প্রমাণ করতে চাইছেন। এরপরই পরিস্থিতি বিবেচনা করে কঠোর আন্দোলন করতে চান।
আর সব বিবেচনা করে সার্বিক বিষয় নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার রাতে ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এরপর আগামীকাল রাতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে।