মামু দেখছো, সামনে তোমার কাস্টমার।' গাড়ি চালানোর সময় সামনে রিকশা আরোহী এক নারীকে দেখে এ মন্তব্য করেন আবুল কালাম। গাড়িতে তার পাশে বসা হেমায়েত হোসেন হিমু ততক্ষণে দিনের প্রথম টার্গেট খুঁজে পেয়েছে। কালামকে তার জবাব_ 'হ দেখছি, রিকশাটার পাশে পাখির মতো গিয়া খাড়া। আমি টান মারার লগে লগে তুই গিয়ার মারবি।' নির্দেশমতো রিকশাটির পাশে গিয়ে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে থাকে কালাম। সে সুযোগে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হিমু ওই নারীর হাতব্যাগ ধরে টান দেয়। ব্যাগের ফিতা বাহুতে পেঁচানো থাকায় ভারসাম্য রাখতে না পেরে রাস্তায় পড়ে যান রিকশা আরোহী আয়শা আক্তার রিপা। ততক্ষণে জোরগতিতে
গাড়ি ছুটছে সামনের দিকে। গাড়ির সঙ্গে প্রায় ৫০০ গজ ছেঁচড়ে যেতে যেতে
কেড়ে নেওয়া ব্যাগটিতে ছিনতাইকারীরা পেয়েছিল মাত্র সাত হাজার টাকা।মৃত্যু হয় গৃহবধূ রিপার। এভাবে রিপার ছয় বছরের শিশুকে মা-হারা করে
দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর ধানমণ্ডির সোবহানবাগে ছিনতাই করতে গিয়ে এক নারীকে টেনে-হিঁচড়ে হত্যার এমন নৃশংস বর্ণনা দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। ছিনতাইয়ে জড়িত অভিযোগে সোমবার গভীর রাতে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ। তারা হলো_ গাড়িচালক আবুল কালাম, হেমায়েত হোসেন হিমু ও আলমগীর হোসেন রতন। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী বলে জানিয়েছে পুলিশ। ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়িটি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকের। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আলমগীর হোসেন রতনের কাছ থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য গাড়িটি ভাড়া নিয়ে ছিনতাইয়ে বের হতো অপর দু'জন। বিনিময়ে রতন পেত দুই হাজার টাকা। তবে গাড়িটির প্রকৃত মালিক সে নয়। সোমবার রাতে জড়িতদের গ্রেফতার ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, ছিনতাই করা চারটি ভ্যানিটি ব্যাগ, একটি ল্যাপটপ ব্যাগ ও দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মিরপুর, পল্লবীসহ বিভিন্ন থানায় ছিনতাই-ডাকাতির মামলা রয়েছে। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে গৃহবধূর করুণ মৃত্যুর পর ভোরবেলায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের এই মুখপাত্র।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ধানমণ্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক সমকালকে জানান, ঘটনার দিন ২৮ অক্টোবর ভোর ৫টায় মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের একটি গ্যারেজ থেকে গাড়িটি নিয়ে বের হয় আবুল কালাম ও হেমায়েত হোসেন হিমু। সেখান থেকে তারা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দর পর্যন্ত যায়। এরপর ফিরে আসে সদরঘাট। তখন পর্যন্ত ছিনতাইয়ের উপযুক্ত কোনো টার্গেট না পেয়ে নিউমার্কেট হয়ে গাবতলীর দিকে যাচ্ছিল। পথে ধানমণ্ডির সোবহানবাগ মসজিদের সামনে গৃহবধূ রিপা ও তার বন্ধু খান মো. ইব্রাহিমকে তারা রিকশায় যেতে দেখে। হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নেওয়ার সময় 'দুর্ঘটনাবশত' রিপার মৃত্যু হয় বলে দাবি তাদের। ছিনতাই ও হত্যার দায় স্বীকার করে তারা এজন্য অনুতপ্ত বলেও দাবি করে। আজ তাদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডের আবেদন করা হবে।
ওসি জানান, ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়িটির মালিক একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ওয়াহিদ মুরাদ জামিল। স্থানীয় ক্যাডার রতন জোর করে তার গাড়িটি ব্যবহার করত। জামিলের আরও গাড়ি থাকায় তিনি 'ঝামেলা' এড়াতে রতনকে গাড়িটি দিতেন। তবে ছিনতাইয়ে গাড়িটি ব্যবহারের বিষয় জানতেন না বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন জামিল। তদন্তে তার কোনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হেলাল উদ্দিন বলেন, নিহত রিপার ব্যাগে সাত হাজার টাকা ছিল। ছিনতাইকারীরা তার মধ্যে দুই হাজার গাড়ির ভাড়া বাবদ রতনকে দেয়। বাকি পাঁচ হাজার টাকা হিমু ও কালাম ভাগ করে নেয়। রিপার মোবাইল ফোন রাস্তায় কোথাও পড়ে ভেঙে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে গ্রেফতার : ধানমণ্ডি থানার ওসি জানান, ঘটনার পর জড়িতদের শনাক্ত করতে সোর্স নিয়োগ করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যায়, কারা এ ছিনতাই করেছে। মূলত ঘটনার পর থেকে তারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের সন্দেহ করা হয়। এরপর সংশ্লিষ্টতার তথ্য নিশ্চিত হয়ে তাদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ঘটনার পর থেকে মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল। তদন্তের একপর্যায়ে জড়িত আবুল কালামের সন্ধান মেলে। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর সে দাবি করে, ছিনতাইকালে ওই নারীর মৃত্যুর পর থেকে আতঙ্ক ও অনুশোচনায় ঘুমাতে পারছিল না সে। সে ঘটনার পুরো বর্ণনা দিয়ে জড়িত অন্য দু'জনের ব্যাপারেও তথ্য দেয়। এরপর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে হিমু ও মিরপুর ৬ নম্বর থেকে রতনকে গ্রেফতার করা হয়। সোমবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত চলে ধারাবাহিক এ অভিযান।