‘নব্য মীরজাফরকে বিদায় করেই দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব’———বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ মাঠে বুধবার বিকেলে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত বিশাল সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং দেশব্যাপী গুম, খুন ও দুর্নীতির প্রতিবাদে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে কিশোরগঞ্জে এ জনসভার আয়োজন করা হয়।
বক্তব্যের শুরুতে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলনে কিশোরগঞ্জ বাসীর স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে তাদের ধন্যবাদ জানান।
বর্তমান আওয়ামী সরকারকে অবৈধ, জনবিচ্ছিন এবং ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, বর্তমান সংসদ একটি অবৈধ সংসদ। বর্তমান সরকার একটি অবৈধ সরকার। গত ৫ জানুয়ারীর প্রহসনের নির্বাচনে কোন ভোট হয়নি। মানুষ ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের পরিবর্তে কুকুর ছিল। তাই এটা জনগণের সরকার না। আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কাজেই বর্তমান সংসদও অবৈধ।
উপস্থিত যুবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা ইয়ংরা ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুটার ইত্যাদির ব্যবহার করেন। সবকিছু সম্পর্কে আপনারা সজাগ। উন্নয়নের সাথে যে সরকারের সম্পৃক্ততা নেই তাদের জন্য কিছু করে লাভ নেই। আমরা অনেক উন্নয়ন করেছিলাম। বিএনপি হল জনগণের দল। বিএনপি উন্নয়নে বিশ্বাসী। কিশোরগঞ্জে রাষ্ট্রপতি আছে, মন্ত্রী আছে তারাও কিশোরগঞ্জের কোন উন্নয়ন করেনি। আর সারা দেশেও কোন উন্নয়ন হয়নি। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জে আসার রাস্তার উন্নয়ন হয়নি। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ।
শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা অবৈতনিক করেছিলাম। মেয়েদের প্রথমে ৮ম শ্রেণী এবং পরে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক করেছিলাম। আমরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিনিময়ে চাল, গম দিয়েছিলাম। নকল বন্ধ করেছিলাম। আমাদের সময় পড়াশোনার মান ভাল ছিল। কিন্তু আজকে সরকার ছাত্রছত্রীদের প্রশ্নপত্র সাল্পাই করে। কম নাম্বার দেয়ায় শিক্ষকদের বহিষ্কার করে। এভাবে তারা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন দেশের উপজেলা হাসপাতাল গুলোতে ডাক্তার থাকে না। আমাদের সময় আমরা হাসপাতালে নিয়মিত ডাক্তার দিয়েছিলাম। মেডিসিন এবং এ্যাম্বুলেন্স দিয়েছিলাম। এখন স্বাস্থ্যখাতেও ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। তাদের অর্থমন্ত্রী বলছে দুর্নীতি অপরাধ না। এ বলে তারা দুর্নীতিকে বৈধতা দিচ্ছে।
দৈনিক প্রথম আলোর পত্রিকার ‘আপনারা দায়মুক্ত’ শিরোনামের একটি সংবাদ সবাইকে দেখিয়ে তিনি বলেন, দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) এখন দুর্নীতি কমিশন। সরকারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু করার কোন অধিকার এদের নেই। এদের অর্থমন্ত্রীর ভাষায় দেশের অর্থনীতি ‘খোপলা’ হয়ে গেছে। ৫ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা (পুরো আওয়ামী লীগ) ব্যর্থ হয়েছি।(প্রথম আলোর উদৃতি)। কাজেই তারা মানে পুরো আওয়ামী লীগ ব্যর্থ।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যথা ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবকলীগ পুলিশের ধার ধারে না। প্যারোলে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরা প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে। আমি বিশ্বজিতের পরিবারের সাথে দেখা করেছিলাম। তাদের সাহায্য করেছি। সুযোগ পেলে আরও করব। দৈনিক মানবজমিনের একটি রিপোর্ট তিনি সবাইকে দেখান যেখানে বলা হয়েছে মন্দিরের ৫১ শতাংশ জমি দখল করেছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই এ কাজ হয়। দেশের সবাই দূরাবস্থায় কিন্তু আওয়ামী লীগ ভালই আছে।
সরকারের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, এ অবৈধ সরকারের আমলে দেশে কি উন্নয়ন হয়েছে? দেশে কোন বিনিয়োগ হচ্ছে না। বর্তমান সরকার দুর্নীতিবাজ সরকার। এরা সদা লুটপাটে ব্যস্ত। গত কয়েক বছরে সরকার দলের একেক জনের সম্পদ বেড়েছে কয়েকশ’ গুণ। শুধু শেয়ার বাজার থেকেই এরা এক লক্ষ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। ডেসটিনি থেকে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, হলমার্ক গ্রুপ থেকে ৩ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপ থেকে ১২শ’ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা, রুপালী ব্যাংক থেকে ১২শ’ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ৬শ’ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক লিমিটেড থেকে ৬০০ কোটি টাকা তারা লুট করেছে। পদ্মাসেতুর মত প্রকল্পও বাদ যায়নি। আর হাসিনার ভাষায় দুর্নীতিবাজরাই দেশপ্রেমিক। আর তাদের অর্থমন্ত্রী বলেন, এ টাকা নাকি সামান্য টাকা।
দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টর ‘বিনিয়োগে ১১ বাঁধা’ শিরোনামের একটি সংবাদ তিনি সবাইকে দেখান যেখানে সরকারের দুর্নীতি ফুটে উঠে। অন্যদিকে আরকটি ছবিতে পুলিশের পাশে ছাত্রলীগের অত্যাধুনিক অগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়ার ছবিটিও তিনি সবাইকে দেখান। বিনিয়োগ করলেই সবাইকে চাঁদা দিতে হয়। তাই কেউ আর বিনিয়োগ করতে চায় না।
তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে কোন বিনিয়োগ নেই। কর্মসংস্থান নেই। যুবকরা বেকার হয়ে বসে আছে। নতুন কোন শিল্পকারখানা হচ্ছে না। আমাদের রিহ্যাব বর্তমানে খুব কঠিন সময় পার করছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তারা বিল্ডিং, এপার্টমেন্ট করছে কিন্তু পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংযোগের অভাবে এদের এসব বিক্রি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, দেশে আইন- শৃংখলার অবস্থা মোটেও ভাল না। কেন ভাল না? এ বিশৃঙ্খলার সাথে আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ জড়িত। দৈনিক ইনকিলাবের ‘আইনের ঊর্ধ্বে নয় পুলিশ’ একটি শিরোনাম তিনি সবাইকে দেখান। টাকার বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জে ১১ জন মানুষকে র্যািব হত্যা করেছে। ৭ জন তারা হত্যা করেছে এবং দেখে ফেলায় আরও ৪জন মাঝিকে তারা হত্যা করেছে। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত র্যা বের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। ইলিয়াস আলী, লাকসামের হিরুকে তারা হত্যা করেছে। তারা ৩১০ জনকে হত্যা করেছে এবং এরকম ৫৬ জনকে গুম করেছে যারা আর ফিরে আসেনি। যুবকদের তারা ধরে নিয়ে যায় এবং তারা আর ফিরে আসেনা। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি রিপোর্ট তিনি সবাইকে দেখান যেখানে বলা হয়েছে যে, ডিবি এখন টাকার বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে ব্যস্ত। এসব করে তারা টাকা কামাচ্ছে এবং প্রমোশনও পাচ্ছে। তারা জোর করে ক্ষমতায় টিকে আছে দেশটাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। দেশের এমন সময়ে মানুষ আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। প্রতিটি জনসভায় লোক শুধু বাড়ছে।
পুলিশের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের কাজ মানুষের নিরাপত্তা দেয়া। অবৈধ সরকারের হয়ে মানুষকে নির্যাতন করা নয়। আপনারা এমন কাজ করলে বিদেশীদের আজকে আপনাদেরকে গুলি, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট দেয়া বন্ধ করে দিতে আহ্বান জানাব। র্যারবকে বিদেশে প্রশিক্ষন না দিতে আহ্বান জানাচ্ছি। মিশনে না নেয়ার জন্য আহ্বান জানাব।
তিনি বলেন, সরকার বলেছিল আপনাদের ঘরে ঘরে চাকুরি দিবে, ১০টাকা সের চাল দিবে। সরকার তা পারেনি। ৩০০টাকার সার আজকে ১২০০টাকা। কাজেই কারা জনগণের জন্য কাজ করেছে? নিশ্চই বিএনপি। তারা আজ বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে দেশের চাল রপ্তানি করে।এভাবে তারা দেশটাকে নিয়ে খেলা করছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ দেশকে রক্ষা করতে হবে।
দেশনেত্রী বলেন, কলকারখানায় পরিপূর্ণ নরসিংদী আজকে গ্যাস, বিদ্যুৎ পায়না। আর সরকার বর্তমানে ব্যস্ত লুটপাট নিয়ে। আমাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য ছিল দেশের উন্নতি। জিয়াউর রহমান দেশে গার্মেন্টস চালু করেছিল। আমরা সেটাকে এগিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের সময় আমরা গার্মেন্টস সেক্টরে খুব ভাল করেছিলাম। চায়না ছিল এক নম্বরে আর আমরা ছিলাম দুই নম্বরে। তাদের কারনে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাদের কারনে আমরা ২ নম্বর থেকে এখন গার্মেন্টস শিল্পে ৪ নম্বরে নেমে এসেছি।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, তারা আজকে আমাদেরকে মিটিং মিছিল করতে দেয় না। ৭ নভেম্বর উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ারদি উদ্দ্যনে আয়োজিত ৮ নভেম্বরের সমাবেশ তারা আমাদের করতে দেয়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আজকে অসংখ্য পুলিশ দিয়ে রেখেছে। এসব বিষয় আজকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কথা বলছে।
দেশনেত্রী বলেন, সরকার নতুন নতুন আইন করছে। আজ বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। দেশের মানুষ আজ ন্যায় বিচার পায়না। উচ্চ আদালতের বিচারকদের ভয় দেখাতে তাদের অপসারনের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেওয়া হয়েছে। বিচারকদের বেঞ্চ দেয়ার ক্ষেত্রেও এখন দলীয়করন করা হয়। ফলে মামলার রায় ঠিকমত হয়না। বিচারের রায় হয় দুই রকম। তাদের দলের জন্য একরকম আর বিরোধীদলের জন্য একরকম। ক্ষমতায় এসে হাসিনা তার নিজের নামের ১৫ মামলা সরিয়ে নিলেও আমার নামে করা ৫টি মামলা তুলে নেয়নি। তাদের নিজেদের ৮ হাজার মামলা তারা তুলে নিয়েছে। কাজেই বিচারকদের স্বাধীন হতে হবে। যে যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ধর্মের সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে বিচারিক কাজ করতে হবে। ঠিকমত বিচার না করলে আল্লাহর দরবারে আপনাদের জবাবদিহিতা করতে হবে। সম্প্রচার নীতিমালা করে মিডিয়ার স্বাধীনতা বন্ধ করে দিচ্ছে। টকশো বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে টকশোতে না নিতে মিডিয়াকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, ক্ষমতা থেকে সরলে এদের অবস্থা এরশাদের চেয়েও খারাপ হবে। কোথাও আশ্রয় নেয়ার জায়গা পাবে না। আমার আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য নয়, দেশের জনগণ এবং সুশাসনের জন্য। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন আমাকে এবং আমার পরিবারকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি যাইনি। কারন দেশের বাইরে আমার কোন ঠিকানা নেই। আমি ১ বছর ৮দিন কারাবরণ করেছি কিন্তু দেশে ছেড়ে যাইনি। কিন্তু আরেক জন (হাসিনা) ঠিকই দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। তারা আমার কাছ থেকে তাদের সরকারের বৈধতা চেয়েছিল কিন্তু আমি দেইনি। কারনে আমি দেয়ার কেউ না। এই দেশের মালিক হচ্ছে জনগণ। শহীদ জিয়া দেশের মানুষের সাথে ছিল। মানুশের জন্য কাজ করেছিল। কাজেই জিয়াউর রহমান দেশের মানুষের ভালবাসা পেয়েছে। তার জানাজায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ শরিক হয়েছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের রক্তে যেমন সিরাজউদ্দৌলা রক্ত আছে তেমনি মীরজাফরের রক্তও আছে। মীরজাফরা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। সেই মীরজাফরকে বিতাড়িত করতে হবে। অত্যাচার অনেক হয়েছে। বেশি অত্যাচার হলে ঢাল-তরবারি আছে। এই নব্য মীরজাফরকে বিদায় করেই দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব।