'আমার মেয়ের মনটা শিশুর মতো কোমল। অন্যের কষ্ট দেখলে নীরবে দু'চোখ অশ্রুসিক্ত হতো। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছিল গরিব-অসহায় মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেবে। সেই বাসনা থেকেই ওর ডাক্তার হওয়া। প্রতি শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পথশিশু ও ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে কাপড়চোপড় বিতরণ করত। বস্তিতে গিয়ে গরিবদের খাবার দিত। মেয়েটা ছিল আমার রত্ন। একবার জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। দু'বার আন্তঃমেডিকেল কলেজ বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। রক্তদাতা হিসেবে ওর পরিচিতি ছিল।'
মেধাবী চিকিৎসক কন্যা শামারুখ মাহজাবিনের (২৬) মৃত্যুর পর এভাবেই গতকাল অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন তার বাবা প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম। মাহজাবিন রাজধানীর হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্নি শেষ করার পর বিএসএমএমইউতে এফসিপিএস ডিগ্রি নিতে ভর্তি হয়েছিলেন।ডা. মাহজাবিনের মৃত্যু ঘিরে অনেক প্রশ্ন
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডির ৬ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা মাহজাবিনকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই বাড়িতে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি। মাহজাবিনের শ্বশুর যশোরের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতান। এই ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে মাহজাবিনের শ্বশুর ও শাশুড়ি ও জামাই হুমায়ুন সুলতানকে আসামি করে ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় মাহজাবিনকে শ্বশুর পক্ষের লোকজনের নির্যাতন ও যৌতুক দাবি ও উচ্চ শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় হুমায়ুনকে গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত রোববার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল রাতে যশোরে নিজ বাড়িতে মাহজাবিনের লাশ দাফন করা হয়।
নিহতের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, 'টিপু সুলতান প্রভাবশালী হওয়ায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাল্টে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। গত বুধবার সকালে তার মেয়ে ফোন করে জানায়, শ্বশুরের অবৈধ কাজের কিছু তথ্য-উপাত্ত তার হাতে এসেছে। ফোনে সব খুলে বলা সম্ভব নয়। তার হাতে আসা তথ্য-উপাত্তের বিষয়টি শ্বশুর জেনে গেছেন। এর সূত্র ধরে কোনো বিপদ হতে পারে।'এদিকে মাহজাবিনের মৃত্যুরহস্য খোলাসা করতে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেতে অন্তত দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। নিহতের বাম হাতের কবজির ওপরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। গলায় কিছু দাগ ছিল। শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। পিঠে কিছু লালচে দাগ ছিল। মেঝেতে পড়ে থাকার কারণে সেটা হতে পারে।
তবে মাহজাবিনের মৃত্যুর পর কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তার স্বজনরা। তাদের বক্তব্য_ কেন বাথরুমের গ্রিলের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় মাহজাবিনকে দেখার পরও পুলিশকে খবর না দিয়ে সরাসরি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো? মাহজাবিনের মৃত্যু নিয়ে কেনই বা তার শ্বশুর লুকোচুরি করলেন? ফোনে একাধিক দফায় নুরুল ইসলামের সঙ্গে তার কথা হলেও বিষয়টি তিনি গোপন করেন।
বিষয়টি ভিন্ন খাতে নিতে লাশ উদ্ধারের পর হঠাৎ স্ত্রীর সঙ্গে টানাপড়েনের গল্প তৈরি করে পুলিশকে অবহিত করা হয়। মাহজাবিনের চরিত্রে কালিমা লেপনে হয়তো এই অপচেষ্টা। কী কারণে মাহজাবিনকে সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে দেওয়ায় বাধা দেওয়া হলো?
ধানমণ্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। তবে মামলা হলেই প্রমাণ হয় না অভিযুক্তরাই খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। হত্যার আলামত পাওয়া গেলেই টিপু সুলতান এবং তার স্ত্রীকেও গ্রেফতার করা হবে। এর আগে নয়। মামলার পর তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন এমন তথ্য জানা নেই। আর ঘটনার পর টিপু সুলতান ও তার স্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে।'একই মামলার এক ও দুই নম্বর আসামিকে না ধরে কেন তিন নম্বর আসামি হুমায়ুনকে গ্রেফতার করলেন_ এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, 'কিছু ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি হওয়ায় মাহজাবিনের স্বামী হুমায়ুনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।'
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানার এসআই কাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার টিপু সুলতানের বাসা বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য দুই আসামির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এখনও ঘটনাস্থল দেখার সুযোগ হয়নি। তবে শুনেছি বাথরুমের যে জায়গা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে গ্রিলের সঙ্গে ঝুলে থাকা সম্ভব নয়। তদন্ত শেষে সব পরিষ্কার হবে।সাবেক এমপি টিপু সুলতান বৃহস্পতিবার জানান, অনেক ডাকাডাকির পর দরজা না খোলায় তা ভেঙে ঝুলন্ত অবস্থায় মাহজাবিনকে পাওয়ার পর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার দাবি তার পুত্রবধূকে কেউ খুন করেনি, এটা আত্মহত্যা।
বৃহস্পতিবার পুলিশ হেফাজতে হুমায়ুন সুলতান দাবি করেন, তার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় কল আসে। কলটি না ধরার কারণ স্ত্রীর কাছে জানতে চান। উত্তরে মাহজাবিন জানান, তার বান্ধবী বারবার ফোন করছে। সন্দেহ হওয়ায় ওই নম্বরে হুমায়ুন ফোন করে একটি ছেলের কণ্ঠ শুনতে পান।
এ নিয়ে দু'জনের মধ্যে মান-অভিমান হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাসায় ফেরার পর স্বামী-স্ত্রী মিলে নামাজ পড়েন। পরে খাবার টেবিলে বসার পর স্ত্রীকে ডাকাডাকি করেন। এরপর বাথরুমের দরজা বন্ধ পান। অনেক ডাকাডাকির পর না খোলায় দরজা ভেঙে ঝুলন্ত অবস্থায় তিনি স্ত্রীকে দেখেন।
মাহজাবিনের বাবা নুরুল ইসলাম জানান, ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল মেয়ের বিয়ে হওয়ার পর হুমায়ুনের প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। প্রথমে তারা জানতেন ছেলে ব্যারিস্টার। পরে জানতে পারেন, তা ঠিক নয়। তবু মেয়ের সংসারের কথা বিবেচনা করে তা মেনে নেন। তিনি বলেন, ছেলে অল্প শিক্ষিত হওয়ায় আমার মেয়েকেও উচ্চ শিক্ষায় বাধা দেওয়া হয়। এফসিপিএসে ভর্তি হতে তাকে নিষেধ করা হয়। মেয়েকে দিয়ে বাসায় কাজ করানোই শ্বশুর-শাশুড়ির পছন্দ ছিল। আর জামাই তার বাবার টাকায় চলায় বউয়ের ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির কোনো অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করেননি।
নুরুল ইসলাম জানান, 'বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে টিপু ফোন করে জানায়, মাহজাবিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। দ্রুত ঢাকায় আসতে হবে। সন্ধ্যায় ফোন করে মেয়ের চরম দুর্ভাগ্যজনক কিছু হলে আমি কী করব এমন পরামর্শ চায়।' এ কথা শোনার পর মনে অজানা আশঙ্কা কাজ করে। দ্রুত আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিয়ে ঢাকায় ছুটে আসি।