যশোর আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতান। স্থানীয় রাজনীতিতে কাউকে কেয়ার না করলেও শুধু পেশীশক্তিনির্ভর নেতাগিরির সত্যিকার জনপ্রিয়তা এখন খুব নির্মমভাবেই আঁচ করতে পারছেন তিনি।
পুত্রবধূ হত্যা মামলায় সস্ত্রিক পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে এক সময়কার ক্ষমতাধর টিপু সুলতানকে। কিন্তু এই দুর্দিনে কোনো নেতাকর্মী বা তোশামোদকারী কেউই নেই তার পাশে। সবাই এড়িয়ে চলছেন।
টিপু তার পুত্রবধূ ডা. শামারুখ মেহজাবিন সুমির হত্যাকাণ্ড মামলায় আসামি হলেও চুপচাপ মনিরামপুর ও জেলা আওয়ামী লীগ। আর যে এলাকার (যশোর-৫) তিন তিনবারের এমপি তিনি সেখানকার মানুষ ও বর্তমান দলীয় নেতাকর্মীরা টিপুর এই দুর্ভোগকে তার দীর্ঘদিনের ‘অপকর্মের’ খেসারত হিসেবেই দেখছেন।
যশোর ও মনিরামপুরের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে খান টিপু সুলতান একটি সমীহ করার মতো নাম। ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া এ নেতা যশোর-৫ আসন থেকে তিন বার এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও যশোর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় তিনি কারাবরণসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। এ কারণেই এসব অর্জন ধরে রাখতে পারেননি। দলের কর্মীদের প্রতি অবজ্ঞা, সব সময় আখের গোছানো পাঁয়তারা ইত্যাদি কারণে সবার কাছে বিরাগভাজন হন তিনি। ক্রমে রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত হন তিনি।
শুধু তাই নয়, সর্বশেষ ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্যের কাছে ১৬ হাজার ৭৬৯ ভোটে পরাজিত হন। অথচ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫১ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে খান টিপু সুলতান হেরে গেছেন।
এর পেছনে টিপুর জনবিচ্ছিন্নতাই দায়ী বলে মনে করেন দলের নেতাকর্মীরা। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণাকালে টিপু পুত্র (যিনি স্ত্রী সুমি হত্যায় অভিযুক্ত) হুমায়ুন সুলতান সা’দাবের গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেয় স্থানীয় জনগণ।
এই রাজনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্যে এবার পড়েছেন পুত্রবধূ ডা. শামারুখ মেহজাবিন সুমির রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায়। টিপু ও তার পরিবার এটা আত্মহত্যা বলে প্রচার করলেও সুমীর বাবা পরিকল্পিত হত্যা দাবি করে মামলা করেছেন। এতে টিপু সুলতান, তার স্ত্রী ডা. জেসমিন আরা, পুত্র হুমায়ুন সুলতান সা’দাব আসামি।
নিহত সুমীর পিতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মেয়ে মরেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। যশোরবাসীসহ দেশবাসীর কাছে মেয়ের খুনিদের বিচার চাই।’
এই দুরবস্থার মধ্যে টিপুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও আওয়ামী লীগ।
কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বিভিন্ন সময় টিপু সুলতান দলের ভেতর ‘টিপু গ্রুপ’ তৈরি করে ক্ষমতা স্থায়ী করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন টিপু সুলতান নিজেই। এমনটিই বলেছেন, দলের দুর্দিনের আরেক কাণ্ডারি মনিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু।
ঢাকায় অবস্থানরত এ নেতা মুঠোফোনে বাংলামেইলকে বলেন, ‘মনিরামপুরে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তিনি (টিপু) দুঃশাসন চালান। দুর্নীতি ও লুটপাট করেন। এসব বিষয়ে আমরা অনেকবার প্রকাশ্যে বলেছি। যে কারণে মানুষ তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাইতো পুত্রবধূ হত্যামামলায় আসামি হলেও জনগণ চেয়ে চেয়ে দেখছেন।’
অপরদিকে, টিপুর পুত্রবধূ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করছে মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ। এজন্য এখনও কোনো কর্মসূচি কিংবা আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতিও দেয়নি সংগঠন।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহামুদুল হাসান মুঠোফোনে বাংলামেইলকে বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডটি পারিবারিক, এর সাথে কোনো রাজনীতির সম্পর্ক নেই।’
একই কথা বলেছে, যশোর জেলা আওয়ামী লীগ। দলের দপ্তর সম্পাদক মীর জহুরুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত দোষত্রুটি দল বহন করবে না। এটা রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নয়। এছাড়া আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আইনের চোখে খান টিপু সুলতান অপরাধ করলে নিয়ম অনুযায়ী তার বিচার হবে, আদালতেই বিষয়টি ফয়সালা হবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধির কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা তা কমে গেলে বা তার গ্রহণযোগ্যতা কমে গেলে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। তখনই তিনি জনগণের আক্রোশের শিকার হন। এজন্য তার ওপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটে।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য খান টিপু সুলতানের মুঠোফোনে (০১৭১২ ১৫৫৩৩৬) যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। পুত্রবধূ হত্যা মামলায় তিনি স্ত্রীসহ পালাতক রয়েছেন। অবশ্য রোববার হাইকোর্ট তাদের আগাম জামিন দিয়েছেন।