পরে বেলা ১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে কনফারেন্স লাউঞ্জে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী এডভোকেট ফারভেজ হোসেন লিখিত আকারে বক্তব্যটি তুলে ধরেন। এসময় অন্য আইনজীবী ব্যারিস্টার সালেহউদ্দিন ও ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন এবং পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আব্দাল আহমদ, বার্তা সম্পাদক জায়েদ চৌধুরী ও সিটি এডিটর এম আবদুল্লাহ ও সিনিয়র সহকারি সম্পাদক কবি আব্দুল হাই শিকদার উপস্থিত ছিলেন।
মাহমুদুর রহমানের বক্তব্যঃ
এত বড় দুঃসংবাদ পেয়ে আপনজনের সাথে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশের কারাবিধিতে রাখায় হয়নি। রেডিওতে খবর শোনা যাবে, টেলিভিশনে শুধু বিটিভিতে রাজ পরিবারের গুণকীর্তন উপভোগের ব্যবস্থা আছে আর ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করলে জেল কর্তৃপক্ষের বাছাইকৃত গুটি কয়েক সরকারি দালাল পত্রিকা পাওয়া যাবে।
এদেশের রকমারি কাল আইনের ভান্ডা বেড়ি লাগানো নতজানু মিডিয়ায় আজ আর প্রকৃত ঘটনা জানার উপায় নেই। দূর্বিষহ উদ্বেগ, উতকন্ঠা নিয়ে সাত দিন অপেক্ষার পর পরবর্তী শুক্রবার সাপ্তাহিক দেখায় স্ত্রী এলে তবেই জানতে পারব এই রহস্যময় অগ্নিকা- সরকারের পরবর্তী জুলুমের জন্যে আমার দেশে আর কিছু অবশিষ্ট রেখে গেল কী না। উপর্যুপরি দু’রাত নির্ঘুম থেকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সীমাহীন জুলুমের কথা শুধু ভাবলাম।
একটি পত্রিকার কণ্ঠরোধ করতে স্বনির্বাচিত এক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের সকল ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ২০১০ সালে আমার গাড়িতে বোমা আর হাতুড়ি দিয়ে যে আক্রমণ শুরু হয়েছিল তার সম্ভবতঃ আপাততঃ সমাপ্তি হলো আমার দেশ অফিস ছাই করে দিয়ে। এর মাঝে আমি দু’দফায় গ্রেফতার হয়েছি, রিমান্ডে নির্যাতনে মৃত ভেবে বিশেষ সংস্থার লোকজন থানার গারদে ফেলে রেখে গেছে, গায়ে জোরে পত্রিকার ছাপাখানা দখল করেছে।
এই বাংলাদেশ কি রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে?৩১ শে অক্টোবর, শুক্রবার, ২০১৪। কাশিমপুর জেল। দুপুরের আহার শেষ করে সবে নিজের সেলে ফিরেছি। ঘড়ির কাঁটা তখনও সম্ভবত দুই এর ঘর ছোঁয়নি। একই ডিভিশন ওয়ার্ডের ভিন্ন সেলে বন্দী জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম হঠাত বিচলিতভাবে আমার সেলে ঢুকেই উদ্বেগ ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, আমার দেশ কত তলায়? প্রসঙ্গহীন এমন প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। অনেকটা হতবুদ্ধি হয়েই বললাম, জানি না তো, জিজ্ঞাসা করিনি।
শুক্রবার পরিবারের সঙ্গে আমার সাপ্তাহিক দেখার নির্ধারিত দিন। ওই দিন সকাল এগারোটায় তিরিশ মিনিটের সাক্ষাত শেষ করে স্ত্রী এবং মা বাড়ী ফিরে গেছেন। স্ত্রী বলে গিয়েছিলেন আর্থিক টানাটানিতে আর সামলাতে না পেরে আমার দেশ অফিস কাওরান বাজার থেকে উঠে যাচ্ছে নিকেতনে কম ভাড়ার এক এপার্টমেন্টে। শুক্রবার বাদ জুম্মা বিএসইসি ভবনের বর্তমান অবস্থান থেকে মালপত্র সরানোর কথাও শুনেছিলাম। স্ত্রী বলে গিয়েছিলেন, সরকারি কর্পোরেশন বিএসইসি’র কর্তাব্যক্তিরা নানা উপায়ে হয়রানি করছে। আজহার ভাই-এর প্রশ্নে ভেবেছিলাম নতুন জায়গায় কত তলায় আমার দেশ যাচ্ছে সেটাই তিনি জানতে চেয়েছেন। সে তথ্য আমারও জানা ছিল না। তিনি একটু অসহিষ্ণু হয়েই বললেন, কাওরান বাজার কত তলায় অফিস? প্রশ্নের উদ্দেশ্য এবারও বুঝতে না পেরে খানিক বিস্ময়ের সাথেই জবাব দিলাম, এগারো তলায়। তখনই জানলাম আগুনে পুড়ছে আমার দেশ।
অসহায় বন্দী আল্লাহর কাছে জালিমের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো ছাড়ার কি করার আছে? কারো শোনার জন্য নয়, নিজেকেই কেবল বললাম, অফিস তো বন্ধ, আজ মালপত্র সরিয়ে নেবে, আগুন লাগবে কেন?
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের স্বীকারোক্তি এবং আওয়ামী সরকারেরই নিযুক্ত মানবাধিকার কমিশনের বাকশালী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্যই প্রমাণ করছে যে প্রজাতন্ত্রের পুলিশ এখন প্রকৃতপক্ষে গোপালগঞ্জের আওয়ামী ক্যাডার। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংস সব কাহিনী দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, বিদেশেরও সভা- সেমিনার, পত্রপত্রিকায় নিয়মিত আলোচিত হচ্ছে। হিটলারের ভয়াবহ গেস্টাপোর সাথে তুলনীয় এহেন বাহিনী আমাদেরই ট্যাক্সের অর্থে প্রতিপালিত হয়ে এক স্বৈরশাসকের আক্রোশ ও প্রতিহিংসা পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল থেকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা দখল করে রেখেছে।
সুতরাং সেই পত্রিকার অফিসে রহস্যজনক অগ্নিকা- ঘটিয়ে সমস্ত রেকর্ডপত্র, কম্পিউটার, সার্ভার, দলিল-দস্তাবেজ ছাই করে দেয়া হবে তাতে বিস্ময়ের কি আছে? এই নাশকতা কারা করতে পারে এবং কোন গোষ্ঠী এর দ্বারা লাভবান হবে সেটি বুঝবার মত বুদ্ধি, জ্ঞান, বিবেক বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। শুনেছি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকারের কোন মন্ত্রী এবং চিহ্নিত আওয়ামী দালাল শ্রেণী মিডিয়ার কাছে বলেছেন যে বীমা থেকে টাকা নেয়ার অসত উদ্দেশ্যে নাকি আমার দেশ কর্তৃপক্ষই আগুন লাগিয়েছে। ঘৃণ্য দুর্নীতিবাজ মানুষরূপী পিশাচদের এমন হীন মানসিকতাই হওয়ার কথা। এই বক্তব্য দিয়ে লুটেরার দল প্রমাণ করেছে যে, এই সব অপকর্ম করতেই তারা অভ্যস্ত।
এরাই বিদেশীদের জন্য নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননার ক্রেস্ট থেকে সোনা চুরি করে, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জাল করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে, শেয়ারবাজার লুট করে, পদ্মা সেতু শুরু না হতেই ঘুষ নিয়ে দেশের মান-মর্যাদা লুটিয়ে দেয়, বিশেষ পরিবারের খুঁটির জোরে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে, আওয়ামী ক্যাডারদের প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচার বিভাগে ঢুকিয়ে তাদের সহায়তায় ভোটারবিহীন নির্বাচনী তামাশা আয়োজনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।
দেশের জনগণ ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ অফিসের মালপত্রের জন্য কোন বীমাই করেনি। সরকার যে প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মানসে বছরের পর বছর গায়ের জোরে বন্ধ করে রাখে, অর্থাভাবে সাংবাদিকদের বেতন দিয়ে পারে না, তাদের পক্ষে বীমার প্রিমিয়াম দেয়া সম্ভব হয়নি। যেখানে বীমাই নেই সেখানে বীমার টাকা নেয়ার লোভে নিজেরাই আগুন লাগানোর উদ্ভট চিন্তা একমাত্র গণবিরোধী সরকারের কর্তাব্যক্তি অথবা তাদের পদলেহী সুবিধাভোগীদের পক্ষেই করা সম্ভব। যারা এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে সাধারণ জ্ঞানে তাদেরকেই বরঞ্চ নাশকতায় জড়িত থাকার সন্দেহ করার সুযোগ আছে।
এ দেশে ভবিষ্যতে স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত হলে এই নাশকতাকারীরা অবশ্যই চিহ্নিত হবে।
ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে- আমার দেশের সব মালামাল ভস্মীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভবন মালিক, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা রহস্যময় আচরণ করে চলেছেন। আামদের এত ক্ষয়ক্ষতির পর তাদের তরফ থেকে কোন রকম সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবর্তে অব্যাহত হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের বাধার কারণেই আরো আগে মালপত্র সরানো সম্ভব হয়নি। এর ফলে আমার দেশ আর্থিক ক্ষতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ক্ষতির দায় ভবন মালিক কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। এই ভবনেই এর আগেও আগুন লেগে আমার দেশসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বৈরাচারের কাল হাত সর্বত্র দৃশ্যমান হচ্ছে।
আমার দেশ একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অবর্ণনীয় জলুমের ক্রমাগত শিকার হলেও এ দেশের মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ধ্বজধারী অনেক চেনামুখ নিশ্চুপ রয়েছে। তাদের কেউ সরকারের তল্লীবাহকের ভূমিকা পালন করতেও এতটুকু লজ্জাবোধ করছে না। মুক্ত বিশ্বের দাবিদারদের নীরবতাও লক্ষ্যণীয়। এতে আমরা মোটেও বিস্মিত কিংবা বিচলতি নই। আমার দেশ পত্রিকার তুমুল জনপ্রিয়তা সেক্যুলারিজমের প্রবক্তাদের শংকিত করে তুলেছিল।
এ দেশে সেক্যুলারিজমের মুখোশ পরিহিত ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী মিডিয়ায় তাদের আধিপত্য একচ্ছত্র করে রাখতে চায়। এই গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে নানাবিধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও মিডিয়া জগত দখলে রাখতে তারা ঐক্যবদ্ধ। অফিসে গৃহবন্দী অবস্থায়, গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অপশক্তির মোকাবেলায় দেশবাসীকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়েছিলাম। দীর্ঘ বন্দী জীবন, রিমান্ডে নির্যাতন, পরিবারের হয়রানি এ সব আমাকে আমার বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে বিচ্যূত করতে পারেনি, আমার মনোবলেও এতটুকু চিড় ধরেনি।
পাঠক ও দেশপ্রেমিক জনগণের অপরিমেয়, ভালবাসায় ধন্য আমার দেশ ইনশাআল্লাহ, ভস্মস্তূপ থেকেই পূনর্জম্ম নেবে। মহান আল্লাহ তায়ালা সত্য দ্বারা মিথ্যার মস্তক অবশ্যই র্চূণ করবেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিজয়ের মাধ্যমেই এই রক্তস্নাত বাংলাদেশে একদিন প্রকৃত গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ কাঠামো স্থায়ী রূপ লাভ করবে। আমার দেশ পরিবারের সকল কষ্ট ও ত্যাগ সেদিন সার্থক হবে। দেশবাসীর প্রতি শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিনন্দন। আল্লাহ হাফেজ।