২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির কয়েকজনকে ছাত্র-লীগের একাধিক কর্মসূচিতেও দেখা গেছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত একজনকে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে সক্রিয় দেখা গেছে। তবে তিনি এখন ভারতে পালিয়ে আছেন।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা ওই হত্যা মামলায় ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন পলাতক। বাকি আটজন কারাগারে আছেন। এঁদের সবাই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী।
ওই সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় কামরুল হাসানকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আড্ডা দিতেও দেখা গেছে। এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলে তিনি দ্রুত মোটরসাইকেলে করে চলে যান। তাঁর মুঠোফোনও চালু আছে। গত বৃহস্পতিবার ওই নম্বরে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেন। কিন্তু পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দেন তিনি । পরে কয়েকবার চেষ্টা করলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি কামরুল হাসান গত ৩১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশে যোগ দেন।
ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে কামরুলের অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে হাজারো শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকেন। এর মধ্যে কে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামি, তা খুঁজে বের করা ছাত্রলীগের দায়িত্ব নয়।
যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামি ইমরান হোসেন গত ২৫ আগস্ট দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছেন বলে সভায় উপস্থিত সূত্র নিশ্চিত করেছে। তিনি মিলনায়তনের পেছনের সারিতে বসে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা দৈনিক প্রথম বাংলাদেশের কাছে স্বীকার করলেও তাঁরা স্বনামে তা বলতে চাননি। অবশ্য এই প্রতিবেদক ওই দিন বিকেলেই ইমরানকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বের হতে দেখেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কয়েকজন নেতাও ছিলেন।
জানতে চাইলে সভায় ইমরানের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, ‘ওদের হাতের নাগালে পেলে পুলিশে দেওয়া হবে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল তিনজন নেতা জানান, গত ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দেখা গেছে যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আরেক আসামি আজিজুর রহমানকে।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি রাজন তালুকদারও পলাতক। তিনি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে সক্রিয় আছেন। তাঁর ফেসবুকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজিৎ হত্যার সাত মাস পর দেশ ছেড়েছেন তিনি। গত ১৩ অক্টোবর ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘যে মানুষটার জীবন কাটল মারামারি, কাটাকাটি, গোলাগুলি, বোমাবাজি আর রক্তের খেলায়; তাকে দেখায় মাইরের ভয়। পুরো টাসকি খেয়ে গেলাম।’ কী প্রসঙ্গে এসব কথা লিখেছেন, তা অবশ্য উল্লেখ করেননি।
ফেসবুকে বার্তা পাঠালে রাজন তাঁর মুঠোফোন নম্বর দেন। সেটা ভারতীয় ফোন নম্বর। ওই নম্বরে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ফোন করলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি কলকাতায় আছেন। সময়-সুযোগ বুঝে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। তাঁর দাবি, বিশ্বজিৎকে হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে থাকলেও আক্রমণে ছিলেন না। ছাত্রলীগের একটি পক্ষ তাঁকে মামলায় ফাঁসিয়েছে। তিনি বলেন, শাকিল যদি চাপাতি দিয়ে না কোপাতো, তাহলে বিশ্বজিৎ মারা যেত না এবং ঘটনাও এতদূর গড়াতো না।
রাজন নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও বেসরকারি একাধিক টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিশ্বজিৎকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন রাজন। তখন তাঁর মাথায় সাদা রঙের টুপি (ক্যাপ) ও মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে রাজন মঙ্গলবার গনমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ফুটেজের ওই ব্যক্তি তিনি নন।
রাজনের ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় আছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমসহ সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ বিষয়ে বদিউজ্জামান পদৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, তাঁর ফেসবুকে পাঁচ হাজারের অধিক বন্ধু রয়েছে। এর মধ্যে রাজন আছে কি না, তা তিনি জানেন না।
ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শরিফুল ইসলামও ফেসবুকে রাজনের বন্ধু ছিলেন। তিনি সম্প্রতি রাজনকে ‘আনফ্রেন্ড’ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
সাজাপ্রাপ্তরা: এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুজন—রাজন তালুকদার ও নূরে আলম এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত খন্দকার ইউনুস আলী, মনিরুল হক, তারিক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম (২), কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন পলাতক রয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ছয়জন—রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, ইমদাদুল হক, কাইয়ুম মিয়া ও সাইফুল ইসলাম এবং যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া এইচ এম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে আছেন। এঁরা সবাই বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছেন, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ তদন্তের তদারক কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় যায়। সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তার পরও এসব আসামি ধরতে ডিবি তৎপর রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
আগামী ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিতের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর বাবা অনন্ত দাস বললেন, ‘এখন একটাই চাওয়া, মৃত্যুর আগে ছেলের হত্যাকারীদের সাজা দেখে যেতে চাই।’ তিনি হতাশাযুক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী চলে আইছে। কিন্তু এহনো বেশির ভাগ আসামি ধরাই পড়ল না।’